দেশের খবর: একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভায় ভোটের আগে ‘অপপ্রচার’ ঠেকাতে ইন্টারনেটের গতি কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তারা বলেছেন, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতার ওপর জঙ্গি হামলা অথবা গুপ্তহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও ইতিমধ্যে ওইসব নেতাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে বলেও জানানো হয় বৈঠকে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বৈঠকে দেশের সব বাহিনীর প্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, সব রিটার্নিং কর্মকর্তা, জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যম কর্মী ও পর্যবেক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। পাশাপাশি তারা ভোটের আগের তিন দিন মোবাইল ব্যাংকিং ও কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ব্যাংক থেকে প্রচুর নগদ অর্থ উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব অর্থ উত্তোলনের ওপর মনিটরিং প্রয়োজন। ১০ ডিসেম্বর সংসদের ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় দু’জন নিহত হওয়ার বিষয়কে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেন বৈঠকে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা। কমিশনকে তারা জানিয়েছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ইসির নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটি খুব দুরূহ।
তিনি বলেন, সরকার সবার প্রতি সমান আচরণ করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যদি নির্বাচন হয়, তবে এই নির্বাচন অবশ্যই স্বচ্ছ ও শুদ্ধ হতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রার্থী ও ভোটাররা ভোট দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি আসবেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। অতি উৎসাহ বা নির্লিপ্ততার ব্যাপারে তিনি সবাইকে সতর্ক করেন।
বৈঠকে কমিশনার কবিতা খানম ঢাকা ডিসি ও জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ঢাকা-১ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাককে পুলিশের আটকের বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন। তিনি বলেন, তাকে আটকের খবর শুনে ঢাকার ডিসির কাছে ফোন করেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ডিসি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। কবিতা খানম বলেন, এই যদি পরিস্থিতি হয়, তাহলে প্রশাসনের সমন্বয়টা কীভাবে থাকবে।
তিনি বলেন, কারণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করলে সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে। সবার প্রতি আইনের প্রয়োগ অভিন্ন হতে হবে। কেন ও কীভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তা রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানেন না, তাহলে কীসের সমন্বয় আছে?
কবিতা খানম আরও বলেন, ‘ভোটার ও জনগণ সবাই ইসির দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের প্রশ্ন— আমরা ভোট দিতে পারব কি-না, ভোট দিয়ে ফিরে আসতে পারব কি-না? আমাদের কথা হলো ইসির ভাবমূর্তি যেন ক্ষুণ্ণ না হয়।’
কমিশনার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আইনানুগভাবে প্রার্থীরা যেন প্রচার চালাতে পারেন, ভোটাররা যেন ভোট দিতে পারেন। কোনো ধরনের সহিংসতা ও প্রাণহানি হোক তা আমরা চাই না।’ তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের অতি উৎসাহিত না হওয়ার পরামর্শ দেন।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, নির্বাচনে মোবাইল ব্যাংকিং ও বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়। এসব দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয় রয়েছে জানিয়ে পুলিশের আইজি বলেন, তার জীবনে দেখা এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ সমন্বয়। এ রকম সমন্বয় তিনি কখনও দেখেননি। নির্বাচনে টাকার লেনদেনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা তোলা হচ্ছে। এগুলো কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হচ্ছে কি-না, তা দেখতে হবে। পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্ট সেক্টরে উত্তপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচনে কিছু জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে পারে। ভোটের মাঠেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হতে পারে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ও কপবাজারের এসপিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
আইজিপি বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা নির্বাচন বানচাল করার জন্য কয়েক হাজার ক্যাডার ঢাকায় আনার পরিকল্পনা করেছে। এসব সংগঠন যেন কোনো ধরনের অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার ঠেকাতে তিনি নির্বাচনের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি থেকে নামিয়ে টু-জি করা এবং ভোটকেন্দ্রে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সরাসরি সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দেন।
র্যাবের ডিজি বলেন, নির্বাচনী সহিংসতায় দু’জনের মৃত্যু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা যাচাই করা হবে। ২০১৪ সালের মতো কোনো ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত করে গুজব ছড়িয়ে যাতে নির্বাচনী পরিবেশ বানচাল করতে না পারে সেদিকে সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। বিটিআরসির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বৈঠকে তিনি ভোটের সময় তিন দিনের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি থেকে নামিয়ে টু-জিতে আনার প্রস্তাব করেন।
নির্বাচনে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি থেকে টু-জিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাবে আনসারের মহাপরিচালকও একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ভোটের সময়ে মিডিয়া কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিমালা গ্রহণ করা যায়, তা ইসির ভেবে দেখা দরকার। এ ছাড়া বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রায় ১৫ থেকে ১৬ জেলার পুলিশ সুপার গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান।