দেশের খবর: ৪৭ বছর বয়সী বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বছর প্রধান নির্বাহী নারী। বর্তমানে জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। কিন্তু সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব এখনো সীমিত। সংরক্ষিত আসনের ৫০ জনের বাইরে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারীর সংখ্যা তেমনভাবে বাড়ছে না। সংসদ নির্বাচনের আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের কমিটির ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ সদস্য নারীদের জন্য রাখার বিধান রাখা হলেও তা পূরণের চেষ্টা অনেক দলেরই নেই।
জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সরাসরি ভোটে লড়েছিলেন মাত্র দুজন নারী। তাও প্রধান দল থেকে নয়। তাঁরা জিততে পারেননি। দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে ১৩ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। সে সময় ক্ষমতাসীন দলের একজন নারী প্রার্থীও ছিলেন না। ওই নির্বাচনে তিন নারী প্রার্থী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেলেও জিততে পারেননি। পরে মুসলিম লীগের খান-এ সবুরের একটি অতিরিক্ত আসন খুলনা-১৪ থেকে উপনির্বাচনে একই দল থেকে নির্বাচিত হন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। এ হিসেবে তিনি প্রথম নির্বাচিত নারী সদস্য।
নারীরা সরাসরি নির্বাচনে সফলতা লাভ করেন তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনে। এ নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনাসহ তিনজন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হন তিনটি আসন থেকে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী হিসেবে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন খালেদা জিয়া। পরের ২৭ বছরের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়াই বছর বাদ দিয়ে বাকি সময় দেশের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে নারীরাই রয়েছেন।
কিন্তু এই শীর্ষপদগুলো ছাড়া নারীর অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৫৯ জন। এরপর আবার কমেছে। দশম সংসদ নির্বাচনে ছিলেন ২৯ জন।
এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন ১১৮ জন নারী। এর মধ্যে বিএনপির ৪৩, আওয়ামী লীগের ১৯, স্বতন্ত্র ১৮, জাতীয় পার্টির ১১ ও অন্যান্য দলের ২৭ জন। তাঁদের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের বাছাইয়ে বাদ পড়েন বিএনপির খালেদা জিয়াসহ ১০, জাতীয় পার্টির তিন এবং স্বতন্ত্র ১২ সহ মোট ২৬ জন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনে আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পান। পরে টিকে থাকাদের অনেকেই তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৩০০ আসনের মোট এক হাজার ৮৪৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬৭ আসনে ৬৮ জন। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন দুটি আসনে। একটি আসন থেকে তিনি পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর ওই আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার আর সুযোগ নেই।
বলা হয়ে থাকে, সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা জনগণের মনোনীত প্রতিনিধি নন, দলের বা দলের নেতার আস্থাভাজন। তাঁদের কেউ কেউ কোনো প্রয়াত নেতার স্বজন। তাঁদের অনেকের কোনো জনসেবার অভিজ্ঞতা নেই। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আর সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যকে জনগণ একই চোখে দেখে না। সরাসরি ভোটে যিনি নির্বাচিত তাঁর জনগণের কাছে কিছুটা হলেও জবাবদিহি থাকে। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা এখনো কম। তবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
প্রথম নির্বাচন: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। এ নির্বাচনে দুজন নারী প্রার্থী তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁরা হলেন খুলনা-১৩ আসন থেকে ন্যাপের (মোজাফফর) রওশানারা বেগম এবং কুমিল্লা-৫ ও ৬ আসন থেকে জাসদের মমতাজ বেগম। তাঁরা নির্বাচিত হতে পারেননি। সে সময় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে কোনো নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন না।
দ্বিতীয় নির্বাচন: ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে ১১টি আসনে ১২ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপির কোনো নারী প্রার্থী ছিলেন না। আওয়ামী লীগের (মালেক) ছিলেন তিনজন। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ১২ নারী প্রার্থী ছিলেন—বগুড়া-৫ আসন থেকে জাসদ (তোহা) সালেহা সুলতানা, যশোর-৬ আসন থেকে স্বতন্ত্র জাহানারা খাতুন, খুলনা-৭ থেকে আওয়ামী লীগ (মালেক) বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, টাঙ্গাইল-৪ থেকে একই দলের লাইলা বেগম, জামালপুর-১ থেকে স্বতন্ত্র মমতাজ বেগম, জামালপুর-৫ থেকে ন্যাপ (নাসের) জিন্নাতুন নেছা, ময়মনসিংহ-২৩ থেকে স্বতন্ত্র হোসনে আরা খাতুন, ঢাকা-১৩ থেকে আওয়ামী লীগ (মালেক) বেগম নূরজাহান মোর্শেদ ও বাংলাদেশ গণফ্রন্টের নূর সুলতানা চৌধুরী, ঢাকা-১৫ থেকে বাংলাদেশ গণফ্রন্টের আমেনা বেগম, ঢাকা-১৭ থেকে সিপিবির আয়েশা খাতুন এবং ঢাকা-২৩ থেকে ইউপিপির আনোয়ারা বেগম। এই নির্বাচনেও নারী প্রার্থীরা কেউ জয়ী হতে পারেননি। তবে আওয়ামী লীগ (মালেক) প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পান। তবে উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের খান-এ সবুরের ছেড়ে দেওয়া আসনে নির্বাচিত হন তাঁরই দলের সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ।
তৃতীয় নির্বাচন: ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট বর্জন করে। এ নির্বাচনে শেখ হাসিনাসহ তিনজন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হন তিনটি আসন থেকে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী হিসেবে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই নির্বাচনে ১৫টি আসনে মোট ১৩ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। আওয়ামী লীগের ছিলেন পাঁচজন আর জাতীয় পার্টির দুজন। শেখ হাসিনা ঢাকা-৭ ও ১০ এবং গোপালগঞ্জ-১ ও ৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ঢাকা-১০ এবং গোপালগঞ্জ-১ ও ৩ আসনে নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে অন্য প্রার্থীরা হলেন কুড়িগ্রাম-২ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাতেমা, কুষ্টিয়া-২ থেকে জনদলের ফিরোজা খাতুন, খুলনা-৩ থেকে আওয়ামী লীগের বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ও জাতীয় পার্টির হাসিনা বানু শিরি (নির্বাচিত), পটুয়াখালী-২ স্বতন্ত্র নূরজাহান বেগম, টাঙ্গাইল-৪ স্বতন্ত্র বেগম লায়লা সিদ্দীকা (নির্বাচিত), নেত্রকোনা-১ জাসদ (রব) রোশনারা মালেক, কিশোরগঞ্জ-৩ জাতীয় পার্টির সবিতা মাহবুব, ঢাকা-৯ আওয়ামী লীগ প্রার্থী সৈয়দা ফিরোজা বেগম (দ্বিতীয়), নারায়ণগঞ্জ-৫ আওয়ামী লীগের নাজমা রহমান (দ্বিতীয়), ফরিদপুর-২ আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী (দ্বিতীয়) এবং কুমিল্লা-৩ স্বতন্ত্র রাহেলা বেগম।
চতুর্থ নির্বাচন: ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট এবং বিএনপির খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিন নারী নির্বাচিত হন। তাঁরা হলেন নীলফামারী-১ মনসুরা মহিউদ্দিন, ময়মনসিংহ-৪ বেগম মমতা ওহাব এবং নোয়াখালী-৫ থেকে বেগম হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ।
পঞ্চম নির্বাচন: ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৬টি আসনে ৩৯ জন। এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বগুড়া-৭, ঢাকা-৫, ঢাকা-৯, ফেনী-১ ও চট্টগ্রাম-৮ এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ-৩ থেকে, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ফরিদপুর-২ থেকে এবং মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-২ থেকে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া এবং এর পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টুকু বাদে নারীরাই রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
ষষ্ঠ নির্বাচন: ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ নির্বাচন ছিল দেশের অন্যতম একটি ব্যর্থ নির্বাচন। গঠিত সংসদ মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হয়। এ নির্বাচনের তথ্যও নির্বাচন কমিশন সংরক্ষণ করেনি। তবে গণমাধ্যমে সে সময় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই নির্বাচনে খালেদা জিয়াসহ তিন নারী নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্য দুজন হচ্ছেন খুরশীদ জাহান হক ও অধ্যাপক জাহানারা বেগম।
সপ্তম নির্বাচন: ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের সপ্তম সাধারণ নির্বাচনে ৪৯টি আসনে ৩৭ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শেখ হাসিনা বাগেরহাট-১, খুলনা-১ ও গোপালগঞ্জ-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১-এই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বতাি করে পাঁচটিতেইে নির্বাচিত হন। রওশন এরশাদ শেরপুর-১, ময়মনসিংহ-৪, ৮ ও ১১ এই চার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ময়মনসিংহ-৪-এ নির্বাচিত হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বেগম মেরিনা রহমান রংপুর-২ ও ৬ এবং কুড়িগ্রাম-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোনোটাতেই নির্বাচিত হতে পারেননি। জাতীয় জনতা পার্টি (শেখ আসাদ) থেকে বেগম রোকেয়া ফিরোজ নওগাঁ-৩ ও রাজশাহী-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হতে পারেননি। এ নির্বাচনে অন্য নারী প্রার্থীদের মধ্যে বিএনপির খুরশীদ জাহান হক দিনাজপুর-৩ থেকে এবং আওয়ামী লীগের মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-২ থেকে নির্বাচিত হন।
অষ্টম নির্বাচন: ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সাধারণ নির্বাচনে ৪৬টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন ৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে নির্বাচিত হন ছয়জন। এ নির্বাচনেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭, খুলনা-২ ফেনী-১ ও লক্ষ্মীপুর-২—এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই জয়ী হন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রংপুর-৬, নড়াইল-১ ও ২, বরগুনা-৩ ও গোপালগঞ্জ-৩—এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রংপুর-৬ বাদে অন্য চারটি আসনে নির্বাচিত হন। ইসলামী ঐক্যজোটের রওশন এরশাদ গাইবান্ধা-৫ ও ময়মনসিংহ-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গাইবান্ধা-৫ আসনে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া নীলফামারী-১ থেকে আওয়ামী লীগের হামিদা বানু শোভা, দিনাজপুর-৩ থেকে বিএনপির খুরশীদ জাহান হক এবং ঝালকাঠি-২ থেকে বিএনপির ইশরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টু নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নারী প্রার্থী ছিল ১০ জন এবং বিএনপির ছিল চারজন।
নবম নির্বাচন: ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সাধারণ নির্বাচনে নারী প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ছিল ৬৪ আসনে ৫৯ জন। এর মধ্যে ২৩টি আসনে ১৯ জন বিজয়ী হন। এ নির্বাচন থেকে একজন প্রার্থীর তিনটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সে কারণে শেখ হাসিনা এ নির্বাচনে রংপুর-৬, গোপালগঞ্জ-৩ ও বাগেরহাট-১-এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই; খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭ এবং ফেনী-১-এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই বিজয়ী হন। রওশন এরশাদ গাইবান্ধা-৫ ও ময়মনসিংহ-৫ এ দুই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটিতেই পরাজিত হন। আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীদের মধ্যে গাইবান্ধা-২ আসনে মাহাবুব আরা বেগম গিনি, কুষ্টিয়া-৪ থেকে সুলতানা তরুণ, বাগেরহাট-৩ থেকে হাবিবুন নাহার, খুলনা-৩ থেকে মন্নুজান সুফিয়ান, শেরপুর-২ থেকে মতিয়া চৌধুরী, নেত্রকোনা-৪ থেকে রেবেকা মমিন, মুন্সীগঞ্জ-২ থেকে সাগুফতা ইয়াসমিন, ঢাকা-৪ থেকে সানজিদা খানম, ঢাকা-১৮ থেকে সাহারা খাতুন, গাজীপুর-৫ থেকে মেহের আফরোজ, নারায়ণগঞ্জ-৫ থেকে সারাহ্ বেগম কবরী, ফরিদপুর-৪ থেকে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ফরিদপুর-৪ থেকে নিলুফার জাফর উল্লাহ ও চাঁদপুর-৩ থেকে ডা. দীপু মনি নির্বাচিত হন। বিএনপির অন্য নারী প্রার্থীদের মধ্যে সিরাজগঞ্জ-২ থেকে রুমানা মাহমুদ ও কক্সবাজার-১ থেকে হাসিনা আহমেদ নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ-৪ থেকে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির বেগম মমতাজ ইকবাল।
দশম নির্বাচন: দশম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসহ ২৮টি দল নির্বাচন বর্জন অথবা নির্বাচনী মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। অংশ নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা দলগুলোসহ ১২টি দল। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় এই নির্বাচনে মোট নারী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০ আসনে ২৯ জন। এর মধ্যে ১৯ আসনে ১৮ জন নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনা নির্বাচিত হন রংপুর-৬ ও গোপালগঞ্জ-৩ থেকে। আওয়ামী লীগের অন্য প্রার্থীদের মধ্যে গাইবান্ধা-২-এ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, যশোর-৬-এ ইসমাত আরা সাদেক, খুলনা-৩-এ বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, শেরপুর-২-এ বেগম মতিয়া চৌধুরী, নেত্রকোনা-৪-এ রেবেকা মমিন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়), মানিকগঞ্জ-২-এ মমতাজ বেগম (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়), মুন্সীগঞ্জ-২-এ সাগুফতা ইয়াসমিন, ঢাকা-১৮ থেকে সাহারা খাতুন, গাজীপুর-৪ থেকে সিমিন হোসেন রিমি, গাজীপুর-৫-এ মেহের আফরোজ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়), ফরিদপুর-২-এ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়), চাঁদপুর-৩-এ ডা. দীপু মনি (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) এবং নোয়াখালী-৬ থেকে আয়েশা ফেরদাউস নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে বরিশাল-৬-এ নাসরিন জাহান রত্না (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) ময়মনসিংহ-৪-এ রওশন এরশাদ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) এবং ঢাকা-১-এ সালমা ইসলাম নির্বাচিত হন। ফেনী-১-এ জাসদের শিরীন আখতার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
সংরক্ষিত নারী আসন: ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয়। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত করা হয়। ১৯৯০ সালে সংবিধান সংশোধন (দশম সংশোধন) করে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংসদে ৩০টি নারী আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান রাখা হয়। ওই সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০০ সালে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের বিলুপ্তি ঘটে এবং সে সময় যাঁরা সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদ হিসেবে বহাল ছিলেন তাঁদের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নারী নেত্রীরা সে সময় এই দাবি উত্থাপন করেন যে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে এবং ওই সব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেহেতু সংসদে সংবিধান সংরক্ষণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সংখাগরিষ্ঠতা নেই, সেহেতু নারী আসন সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষমতাও তাদের নেই। ২০০০ সালে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোনো আসন ছিল না। ২০০৪ সালের মে মাসে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের ৪৫টি নারী আসন আরো ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন নির্বাচনী বিল পাস হয়। একই সঙ্গে আগের ব্যবস্থা পাল্টে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রাপ্ত আসন অনুপাতে সংরক্ষিত মহিলা আসন বণ্টনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের জন্যই এ আসন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দলই সবগুলো আসন পেত। এই আইন অনুসারে অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদের শেষ দিকে এবং নবম ও দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদের প্রথম দিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নবম জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০-এ উন্নীত করা হয় এবং দশম জাতীয় সংসদের জন্য একইভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়।
এরপর গত ৮ জুলাই সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরো ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত এই ৫০টি আসনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
দেশের নারী নেত্রীরা সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের পক্ষে থাকলেও তাঁরা এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের নারী সংগঠনগুলো দাবি করে আসছে সব রাজনৈতিক দলের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার। এ ছাড়া বলা হচ্ছে, যতক্ষণ সে ধরনের আইন প্রণীত না হচ্ছে, নারীর জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন হিসেবে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন রাখতে হবে এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে থাকতে হবে।