সাতক্ষীরা সংবাদদাতা: ফসল উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন সাতক্ষীরার প্রায় ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ কৃষক। সাধারণত উৎপাদনের নিশ্চয়তা ও উৎপাদন বৃদ্ধির প্রত্যাশায় অনেকটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবেই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন তারা। চলতি বছরে যে পরিমান রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, পরের বছর তার চেয়ে বেশি ব্যবহার না করলে লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কৃষককে। শুধু লোকসান নয়, ঘটছে ফসলহানি। তাই বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। সম্প্রতি সাতক্ষীরায় বারসিক ইনস্টিটিউট অব এ্যাপ্লাইড স্ট্যাডিজ (বিয়াস) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিয়াসের শিক্ষার্থী শেখ তানজির আহমেদ ও আসাদুল ইসলাম নামে দুই তরুণ গবেষণাটি করেন। শনিবার (২১ জানুয়ারি) দুপুর ১২টায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘ফসল উৎপাদনে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের অবস্থান অনুসন্ধান: প্রেক্ষাপট সাতক্ষীরা’ শীর্ষক মিট দ্য প্রেস অ্যান্ড ডালায়গে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলে ভরপুর সাতক্ষীরা জেলা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সাতক্ষীরা জেলায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। যা প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য যেমন হুমকি সরূপ, তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। একই কারণে ধ্বংস হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য, নষ্ট হচ্ছে উর্বরতা। আবার কীটনাশক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন না করায় কমছে কৃষকের জীবনী শক্তি। জেলার ৫টি উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে পরিচালিত এই গবেষণাপত্রে বলা হয়, ৬৭ দশমিক ৩ ভাগ কৃষকের মতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য, স্থায়ীভাবে কমে যাচ্ছে উর্বরতা। বাকি ৩২ দশমিক ৭ ভাগ কৃষক এই বিষয়ে ধারণা রাখেন না। ৭৩ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ মনে করেন কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত ফসল খেলে শরীরে ধীর গতিতে দীর্ঘ মেয়াদি বিষক্রিয়া হয়। একইভাবে কীটনাশক ব্যবহারে সতর্ক না হওয়ায় জীবনী শক্তি কমে যায় উৎপাদনকারীর। বাকি ২৬ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ জনস্বাস্থ্যের উপর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে কখনও ভাবেন না। এই গবেষণায় দেখা গেছে, তথ্যদাতাদের ৬৯ দশমিক ৭ ভাগ কৃষকই রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য হুমকি মনে করেন। আর মাত্র ৪২ দশমিক ৮ ভাগ মানুষ প্রতিনিয়ত ‘কি খাচ্ছেন’ সেটা নিয়ে ভাবেন। বাকী ৫৭ দশমিক ২ ভাগ মানুষ থাকেন নীরব। শুধু তাই নয়, এই গবেষণায় উঠে আসা চিত্র অনুযায়ী ৬২ দশমিক ৫ ভাগ কৃষক সীমিত আকারে অর্থাৎ জমি প্রস্তুতের সময় জৈব সার ব্যবহার বা ব্যবহারের চেষ্টা করেন। যদিও জমি প্রস্তুতের পর বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কর্তন পর্যন্ত জৈব সার ব্যবহারের হার ক্রমেই কমতে থাকে। শতকরা ৫৫ ভাগ উৎপাদনকারী কীটনাশক ব্যবহারের সময় কোন প্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। বাকী ৪৫ ভাগ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেন খেয়াল খুশিমতো। যার ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তা ও উৎপাদনকারী- উভয়ই। গবেষণায় বলা হয়, মাত্র ১৯ দশমিক ৭ ভাগ কৃষক বিভিন্ন মাধ্যমে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ ৮০ দশমিক ৩ ভাগ কৃষকের কাছে এখনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ পৌঁছায়নি বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণাপত্রে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ জেলা সাতক্ষীরায় নিরাপদ খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতন করে ক্রমান্বয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিতকরণ, প্রত্যেক কৃষি পরিবারে কেঁচো কম্পোস্টসহ জৈব সার তৈরিতে কারিগরী সহায়তা প্রদান, রাসায়নিক সারের উপর ভতুর্কি কমিয়ে জৈব সার উৎপাদন ও ব্যবহারে ভর্তুকি প্রদান, কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব প্রচার, কীটনাশক কোম্পানির অপতৎপরতা ও কীটনাশক বিক্রি নিয়ন্ত্রণে আনা, ভেজাল সার ও ভেজাল কীটনাশক উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভেজাল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, কৃষকদের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনায় উৎসাহী করে তোলা, কৃষকদের একেক মৌসুমে একেক ফসল ফলানোয় উদ্বুদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। পরে সাতক্ষীরার তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সভাপতি ইয়ারব হোসেনের সভাপতিত্বে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী, সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, আনিছুর রহিম, মমতাজ আহমেদ বাপী, ড. দিলীপ দেব, শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন, রবিউল ইসলাম, আব্দুল জলিল, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী কৃষিবিদ পার্থ সারথী পাল প্রমুখ।