দেশের খবর: একাদশ সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হওয়ার ১১ দিন পরও সংঘাতময় পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি নেই। প্রতিদিনই বাড়ছে সহিংসতা। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) একের পর এক অভিযোগ আসছে। এত দিন সহিংসতার অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে। এবার সরকারের আরেক শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও প্রতিপক্ষের ওপর সশস্ত্র হামলার অভিযোগ জমা পড়ছে ইসিতে। এভাবে নানা অভিযোগের ‘পাহাড়’ জমে উঠলেও ইসি যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না- এমন অভিযোগেরও অন্ত নেই। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও একজন কমিশনারের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ যেভাবে প্রকাশ্যে চলে আসছে তা এক ধরনের নেতিবাচক আবহ সৃষ্টি করেছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কমিশনের আরও সক্রিয় হওয়ার দাবিও রয়েছে তাদের।
বিশ্নেষকরা বলছেন, ভোটের মাঠে, বিশেষ করে সংঘাত প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান হচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভোটের দিনের চিত্র কেমন হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
কমিশন সদস্যদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ বেড়েই চলছে। ভোটে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে সিইসি কে এম নূরুল হুদার বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশনার হিসেবে তিনি তার অস্তিত্বে আঘাত হানার অভিযোগ তুলেছেন সিইসির বিরুদ্ধে। এর আগে মাহবুব তালুকদারের বিরুদ্ধে অসত্য বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন নূরুল হুদা। তাদের এ ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যেও বিভ্রান্তি বাড়ছে। কমিশন সদস্যরা এখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করতে বিভাগীয় শহর সফর করছেন। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা চট্টগ্রাম সফর করেছেন। কবিতা খানম বরিশাল, রাজশাহীতে রফিকুল ইসলাম, সিলেটে মাহবুব তালুকদার ও ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার শাহাদৎ হোসেন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির সদিচ্ছা এখনও প্রমাণ করতে পারেনি ইসি। শুরু থেকেই তারা এক ধরনের গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা দেখাচ্ছে। ভোটের মাঠে দুর্র্বৃত্তরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপকর্ম করে যাচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, নির্বাচন কমিশনারদের বিভিন্নমুখী বক্তব্য নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে কখনও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে ও কথাবার্তায় এমনটা দেখা যায়নি।
সিইসি নূরুল হুদা দাবি করেন, নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্র ইসি কার্যালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদও মনে করেন, ৩০০ আসনের মধ্যে এ পর্যন্ত সহিংসতার যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা শতকরা এক-দুই ভাগ।
ইসি-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম ঠেকাতে সংসদীয় আসনভিত্তিক যুগ্ম জেলা জজ ও সহকারী জজের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি (ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি) এবং নির্বাহী হাকিমরা কাজ করছেন। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে- ইসির এমন আশ্বাসের পরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
শুরুতে ইসির পক্ষ থেকে ঢালাও অভিযোগ না করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ১৫ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানের ৯ ও ১২ নম্বর আবেদনপত্র দুটি ইসি সচিবালয়ের উপসচিব আবদুল হালিম পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর প্রেরণ করেন। বিএনপি নেতাদের দাবি, ওই আবেদনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের নিরাপত্তা এবং বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আবেদনের বিষয়ে তারা কোনো সুফল পাননি।
এদিকে, ইসি আগের পরিকল্পনার অন্তত চার দিন আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে বিজিবি নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে দ্রুতই সেনা মোতায়েনের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় সেনাবাহিনী নামাতে সময় লাগার কারণে আগেভাগেই বিজিবি নামানো হয়েছে। এ ছাড়া ২৪ ডিসেম্বর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারী কমিশনার মাহবুব তালুকদারও মনে করেন, সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বর্তমান কমিশনের ভূমিকাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পর্যবেক্ষকদের মূর্তি হতে বলছে, ভোটকেন্দ্রে সম্প্রচার বন্ধ করতে চাইছে। পাশাপাশি ইন্টারনেটের গতি কমানো ও কেন্দ্রে মোবাইল নিষিদ্ধের মতো পরিকল্পনা অপরাধীদের আরও বেশি উৎসাহিত করবে।
এদিকে, ইসির নানা আশ্বাসের পরও গত বুধবার পিরোজপুর-৩ আসনে বর্তমান এমপি ও মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীর সমর্থকরা এলাকায় পুলিশি পাহারায় সশস্ত্র মিছিল করেছেন বলে ইসিতে অভিযোগ এসেছে। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুর রহমানের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়ে অন্তত ২০-৩০টি অফিস ও দোকানপাট ভাংচুর করেছে। অন্যদিকে মহাজোটের প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, বুধবার সকালে তার সমর্থকদের ওপর আগে হামলা চালানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিকেলে পাল্টা ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে, ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ একাধিক প্রার্থী পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ তুলে বুধবার ইসিতে চিঠি দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও দেশজুড়ে দেখা গেছে নির্বাচনী হামলা, ভাংচুর ও আগুনের অভিন্ন চিত্র। কোথাও বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছেন, কোথাও বা আক্রান্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই বাড়ছে এসব ঘটনার মাত্রা।
আইন-শৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণে সেল গঠন: ভোটের আগে-পরে চার দিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মনিটরিংয়ে সেল গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কমিশনকে অবহিত করবে এবং কমিশনের নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া মনিটর করার জন্য আলাদা একটি কমিটি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ কমিটি করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, এ কমিটি নির্বাচনের দু’দিন আগে থেকে নির্বাচনের পরের দিন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করবে। পাশাপাশি সংশ্নিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচনে মোতায়েন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় করবে। সংশ্নিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সিগন্যাল অপারেটর টিম সেটসহ উপস্থিত থেকে সংস্থার নিজস্ব যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কমিশনের নির্দেশনা তাৎক্ষণিক অবহিত করবে। এ কমিটি রিটার্নিং কর্মকর্তা, জননিরাপত্তা বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। এ বিষয়ে এনআইডির মহাপরিচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কমিশন আইন-শৃঙ্খলা মনিটরিং সেল গঠন করছে। এই সেল নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি কমিশনকে অবহিত করবে। পাশাপাশি ভোটের ফল প্রকাশের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যাতে কেন্দ্রে ডিসপ্লের মাধ্যমে ফল দেখা যায়। এ বিষয়টিও কমিশন পর্যবেক্ষণ করবে। নির্বাচন ভবনের কন্ট্রোল রুম থেকে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হবে।