খুলনা

মহান শহীদের বসতঘর জরাজীর্ণ, ৪৭ বছরে হয়নি স্মৃতিফলক

By daily satkhira

December 21, 2018

অনলাইন ডেস্ক: স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর জন্মভূমিতে হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। জন্মগৃহ ও বসতঘরটি পড়ে আছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই হতে শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়ার মুক্তিযুদ্ধের গল্প বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষই জানে না যুদ্ধকালীন তাঁর সাহসী অবদান সম্পর্কে জানে না। বর্তমান প্রজন্মকে জানানোর মতো কোনো কর্মসূচিও নেয়া হচ্ছে না। এসব কথা বলছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীনের পুত্র, ভাই ও আত্মীয়রা।

খুলনার গল্লামারীতে পাকহানাদারদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের কমান্ডার আমরণ লড়াকু শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন (মানিক মিয়া)’র জন্মভূমি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার আড়ুয়াবর্নী গ্রামে। শহীদ জয়নুল আবেদীনের ভাই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শেখ নোয়াবালী (৬৯) বলেন, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হাজেরা মানিকের বাধা উপেক্ষা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। স্বামী শহীদ হওয়ার খবর পেয়েই ৪ এপ্রিল গর্ভাবস্থায় হাজেরা মানিক মারা যান। এ জন্যে তাকেও শহীদ উপাধি দেয়া হয়। তিনি আরো জানান, যুদ্ধস্থল গল্লামারী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার শীর্ষে রয়েছে তার নাম। খুলনার নিরালা সিটি কলেজ ছাত্রাবাস চত্বরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়ার মাজার, সোনাডাঙ্গায় রয়েছে শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু তার জন্মভূমিতে কিছুই করা হয়নি। এখানকার ৯৫ ভাগ মানুষ জানেই না তাঁর সম্পর্কে।

সাংবাদিক গৌরাঙ্গ নন্দীর লেখা ‘বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসর নেয়া সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন খুলনার গল্লামারীতে পাকহানাদারদের প্রতিরোধ যুদ্ধের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল তার নেতৃত্বে বাংলার একদল তরুণ পাকিস্তানী সেনাদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুখোমুখি যুদ্ধ চলাকালে ওইদিন ভোররাতে যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি পাকহানাদারদের গুলিতে শহীদ হন।

‘শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া ও হাজেরা মানিক স্মৃতি সংসদ’র সাধারণ সম্পাদক শহীদ জয়নুল আবেদীনের ছোট ছেলে শেখ মো. শামসুদ্দোহা বাঙ্গালী জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে শহীদ জয়নুল আবেদীনের মুক্তিযুদ্ধের গল্প ছিল। যা পড়ে শিশুরা তাঁর সম্পর্কে জানতে পারতো। বিএনপি সরকারের আমলে সেই গল্প পাঠ্যবই হতে বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ২০১৪ সালে চিতলমারীতে গঠিত হয় তার মা-বাবার নামে স্মৃতি সংসদ। এটা উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলছে।

চিতলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের আড়ুয়াবর্নী গ্রামের লেহাজ উদ্দীন শেখ ও সাজেদা বেগমের বড় ছেলে শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া। তার গ্রামের জরাজীর্ণ বসতবাড়িতে এখন বাস করেন মানিক মিয়ার মেয়ে জাহানারা বেগম (রিনু)। রিনুর স্বামী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শেখ গোলাম মোস্তফা বলেন, অনেক আগেই এই বসতবাড়িকে ঘিরে যাদুঘর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো জটিলতায় আটকে আছে জানি না!

চিতলমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার মো. আবু তালেব শেখ বলেন, স্বধীনতার ৪৭ বছর পরও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানিক মিয়ার (জয়নুল আবেদীন) জন্মভূমিতে স্মৃতিফলক কিংবা অন্য কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এটা দুঃখ ও লজ্জাজনক! ২০১৬ সালে উপজেলা পরিষদের সভায় পাশ হয়েছিল যে, শহীদ মানিক মিয়ার নামে চিতলমারী সদর থেকে শেরে বাংলা ডিগ্রী কলেজ সড়ক এবং শহীদ মিনার হতে আড়ুয়াবর্নি হয়ে কালশিরা সড়কটি মুক্তিযুদ্ধকালীন আরেক কমান্ডার মল্লিক সামছুল হকের নামে করা হবে। কিন্তু এখনো তা কার্যকর হয়নি।

কলেজ শিক্ষক বেনজির আহম্মেদ টিপুর লেখা ‘চিতলমারীর ইতিহাস’ গ্রন্থ হতে জানা যায়, চিতলমারী উপজেলা সদর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে আড়ুয়াবর্নী গা্রমে ১৯২৮ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। উপমহাদেশে ইংরেজদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য মানুষ যখন উদ্বিগ্ন, তখন বাগেরহাট পিসি কলেজে অধ্যয়নরত তরুণ যুবক জয়নুল আবেদীন ভারতবর্ষের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন (মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে)। এখানে কর্মকালে তিনি বহু সম্মাননা ও উপধিতে ভূষিত হন।

একাত্তরের ২৬ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার খবর পেয়ে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন নিজের দ্বো-নলা বন্দুক, কার্তুজ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। তা নিয়ে অগ্রসর হলে জয়নুলকে বাঁধা দেন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হাজেরা মানিক। তিনি কৌশলে স্ত্রীকে এড়িয়ে যান। এরপর হাজেরা স্বামীকে আটকাতে স্থানীয় মুরব্বীদের নিকট গিয়েও বিফল হন। অতঃপর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া চিতলমারী উপকণ্ঠে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্বে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ব হয়ে তৎকালীন কিছু ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য স্বেচ্ছায় জয়নুলের সাথে আগ্রসর হন বাগেরহাট অভিমুখে।

বাগেরহাট থেকে অ্যাডভোকেট মীর শওকত আলী দারু (সাবেক এমপি), আব্দুর রহমান (সাবেক এমপি)সহ একটি দল অগ্রসর হয় খুলনা অভিমুখে। লক্ষ্য ছিল খুলনার গল্লামারী রেডিও সেন্টার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি স্থাপন করে পাকসেনাদেরদের অবস্থান দেখা ও যুদ্ধের নকশা তৈরি করা। এ সময় গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে জয়নুল বেশ কয়েকবার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং কৌশলে মুক্তি পান।

খুলনার গল্লামারী যুদ্ধের একদিন আগে বানিয়াখামার এসে শেখ আবদুর রাজ্জাক, কামরুজ্জামান টুকু, বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, অছিকুর রহমানসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি। জয়নুল যেদিন পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওইদিন ছিল ৩ এপ্রিল ১৯৭১ রাত ১২টা। উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনাদের গল্লামারি রেডিও সেন্টারে যাওয়ার গতিপথ রম্নদ্ধ করা। মানিক মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে খুলনায় নির্মিয়মাণ সিটি কলেজ হোস্টেলের চিলেকোঠায় অবস্থান নেন। পরদিন সকালে পাকসেনাদের গাড়ি আসতে শুরু করে। জয়নুল ওই গাড়ি বহরে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে ধ্বংস হয় পাকসেনাদের একটি জিপ ও দুটি মিলিটারি ট্রাক। তুমুল যুদ্ধে এলোপাতাড়ি গোলাবর্ষণে জয়নুলের সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠে যান। জয়নুলের বুলেটে প্রায় ৭৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এই সম্মুখ যুদ্ধে এক সময় পাকসেনাদের ব্রাশ ফায়ারে জয়নুলের বুক, মাথা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যান মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তিতুল্য শহীদ সুবেদার মেজর জয়নুল আবেদীন মানিক মিয়া। স্বামী শহীদ হবার খবর শুনে অন্তঃসত্ত্বা হজেরা মানিক অচেতন হয়ে পড়েন। তার জ্ঞান আর ফেরেনি, তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।