জাতীয়

ভোটে গরম পৌষ

By daily satkhira

December 23, 2018

অনলাইন ডেস্ক: ঘনিয়ে আসছে ভোটের দিন। পৌষের শীতের দেশ গরম হয়ে উঠছে নির্বাচনী তাপে। প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারের দ্বারে দ্বারে। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক ক্রিকেট-বীর মাশরাফি বিন মর্তুজা নৌকার টিকিট পেয়ে গতকালই প্রথম ছুটে যান নিজের এলাকা নড়াইলের লোহাগড়ায়। ঢাকায় ‘উধাও’ বিএনপিকে গতকালই প্রথম সরব দেখা গেছে একাধিক আসনে।

নড়াইল নাড়িয়ে দিলেন মাশরাফি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমের অনন্য নজির ক্রিকেট মাঠে বারবার অন্য এক উচ্চতায় স্থাপন করে চলেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পায় দুর্লঙ্ঘ্য এক সাহস। নড়াইলে জন্ম নিলেও মাশরাফি এখন পুরো দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক।

দেশে বর্তমানে বইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উচ্ছল হাওয়া। এরই মধ্যে এক মাস আগে নড়াইল-২ আসনে বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ওই ঘোষণার পর গতকাল শনিবার প্রথম নির্বাচনী এলাকায় গেলেন নড়াইলবাসীর অতি প্রিয় মুখ নৌকার প্রার্থী মাশরাফি। প্রিয় মাশরাফি নড়াইলে

আসছেন, এই সংবাদ জেনে নড়াইল সদর ও লোহাগড়ার মানুষ মেতে ওঠে উৎসবের আমেজ নিয়ে। সকাল থেকে ফুলের তোড়া, দলে দলে মিছিল করে মাশরাফিকে বরণ করে নিতে হাজির হয় হাজারো মানুষ মধুমতী নদীর কালনা ও শঙ্করপাশা ঘাটে। একসময়ের খরস্রোতা মধুমতীর যৌবন হারিয়ে গেলেও মাশরাফিকে ঘিরে গতকাল হাজারো মানুষের প্রাণবন্ত স্রোত ফের রূপ নেয় পুরনো খরস্রোতা মধুমতীর মতো। আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সর্বস্তরের নড়াইলবাসী মাশরাফিকে বরণ করতে, একনজর দেখতে, হাজির হয় কালনা ও শঙ্করপাশা ঘাটসহ লোহাগড়া ও নড়াইল সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে। কালনা-যশোর মহাসড়কের দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ দিনভর ফুলের তোড়া হাতে নৌকার স্লোগান দিয়ে মাতিয়ে তোলে সেখানকার পরিবেশ। এ সময় মাশরাফি হাত নেড়ে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। কালনা ফেরিঘাট থেকে নড়াইল সদরে গাড়ি করে যেতে লাগে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। অথচ গতকাল উপস্থিত সর্বস্তরের ভোটারের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাশরাফির নড়াইল সদর পর্যন্ত পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ মহাসড়কের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া গোলচত্বরে গতকাল দুপুরে ফুলের তোড়া, হাতে তৈরি নৌকা প্রতীক নিয়ে মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিল দুই শতাধিক যুবক। সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ঠায় অপেক্ষার পরও কারো চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। এই যুবকদের একজন শাখাওয়াত হোসেন। মাশরাফির দারুণ ভক্ত। বগুড়ার শাহজাহানপুরের শাখাওয়াত গত ১৬ ডিসেম্বর নড়াইলে এসেছেন মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে। বুকে-পিঠে মাশরাফির ছবি সংবলিত ব্যানার, মাথায় লালসবুজের পতাকা বেঁধে মাশরাফির জন্য ভোট চাইছেন এই যুবক। গত এক সপ্তাহে নড়াইল সদর ও লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিরতিহীন তিনি মাশরাফির জন্য ভোট প্রার্থনা করে চলেছেন। নির্বাচন পর্যন্ত তিনি নড়াইলে থেকে মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাবেন।

বগুড়ার আযিযুল হক কলেজের ছাত্র মাশরাফি-পাগল শাখাওয়াত বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে মাশরাফি ভাইয়ের ভক্ত। নির্বাচন পর্যন্ত নড়াইলে থাকব। এর জন্য পরিবারের অনুমতি নিয়ে নড়াইলে এসেছি। মাশরাফির নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে গণসংযোগ করেছি। দেশপাগল, ক্রিকেটপাগল মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।’

মহাসড়কের পাশেই হাতে ফুল নিয়ে বসে আছেন প্রতিবন্ধী মো. সাগর মিয়া। মাশরাফির কথা জানতে চাইলে সাগর বলেন, ‘মাশরাফি ভাইকে না দেখে গেলে পেটে একটা দানাও পড়বে না। উনার জন্য সকাল থেকে বসে আছি।’

সিলেটের জিন্দাবাজারের মিরা পাবলিকেশন লাইব্রেরির মালিক দিদার রহমানও মাশরাফির জন্য নড়াইলের ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে এসেছেন। পাঁচ দিন ধরে লোহাগড়ায় থেকে তিনি মানুষের কাছে নৌকার জন্য ভোট চাচ্ছেন। দিদার রহমান বলেন, ‘তিনি মাঠে খেলছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। পুরো দেশেই নির্বাচনে এমপি প্রার্থীরা নিজেদের জন্য ভোট চাইছেন। অথচ খেলার কারণে মাশরাফি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ভোট চাইতে পারছেন না। এ কারণে সিলেট থেকে মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে নড়াইলে এসেছি।’

দুপুর ২টায় মধুমতি নদীর শংকরপাশা ফেরিঘাটে মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু, সদর পৌরসভার মেয়র জাহাঙ্গীর হোসেন বিশ্বাস, লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ ফয়জুন আমির লিটু, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও লোহাগড়া পৌর মেয়র আশরাফুল আলমসহ নড়াইল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মী মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল শিকদার বলেন, ‘আমাদের নেত্রী মাশরাফিকে প্রার্থী দিয়েছেন, তাঁকে বরণ করতে আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। দল-মত-নির্বিশেষে নড়াইলের সর্বস্তরের মানুষ নৌকার জন্য মাঠে নেমেছে। বিপুল ভোটে পাশ করবেন মাশরাফি।’

লোহগড়ায় কালনা ফেরিঘাটের পাশে এক পথসভায় মাশরাফি বিন মর্তুজা স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আসছি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে। নড়াইলের প্রতিটি ইউনিয়নে আমি যাব। সবার সঙ্গে কথা বলব। আমি আপনাদেরই সন্তান। আপনারা জানেন আমার প্রতীক হচ্ছে নৌকা। ইনশাআল্লাহ আপনারা নৌকায় ভোট দেবেন। আপনারা যোগ্য মনে করলে আমাকে নৌকায় ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। সে জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।’

লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ সিহানুর রহমান বলেন, ‘এই আসনে মাঠে যুদ্ধ নেই। আমরা অপেক্ষায় আছি কত ভোটের ব্যবধানে মাশরাফিকে জেতানো যায়। ঘরের বউ-ঝিরাও মাঠে নেমেছে। কিশোর-তরুণরা দল বেঁধে ভোট চাইছে। ১৯৭১ সালের পর এমন উৎসবের আমেজে আর কোনো দিন ভোট করেনি নড়াইলবাসী। মাশরাফির জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।’

নড়াইল সদর ও লোহগড়া উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নড়াইল-২ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র বোসসহ নৌকার টিকিট পেতে ১৬ জন জোর লবিং চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নৌকার টিকিট তুলে দেওয়া হয় মাশরাফির হাতে। আর মাশরাফিকে পেয়ে আওয়ামী লীগের সব মনোনয়নপ্রার্থীই এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাশরাফিকে জেতাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে আরেকটি বিষয়, মাশরাফির শ্বশুরবাড়ির এলাকা লোহাগড়ায় বেশি ভোট পাবেন, নাকি নিজের জন্মভিটা নড়াইল সদরে বেশি ভোট পাবেন। দুই উপজেলায় মাশরাফিকে কত বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করা যায়, তা নিয়ে চলছে উভয় উপজেলার মানুষের মধ্যে শীতল প্রতিযোগিতা। মাশরাফির নিজের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নের চারিখাদা গ্রামে। আর শ্বশুরবাড়ি লোহাগড়া উপজেলার নোয়াগ্রাম ইউনিয়নের দেবীগ্রামে। লোহাগড়া উপজেলার ইটনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মাশরাফির বিজয় নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। কিন্তু কত ব্যবধানে বিজয়ী হবেন, সেটাই আমরা ভাবছি। মাশরাফির নিজের উপজেলার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির উপজেলায় যেন বেশি ভোট পান সে জন্য আমরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছি।’

ইটনা যুবলীগের সভাপতি প্রকাশ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘নিজের উপজেলার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির উপজেলায় দ্বিগুণের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন মাশরাফি। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’

মাশরাফির জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইছেন মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আনিসুর রহমান। তিনি নড়াইল সদর পৌর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট খেলে যে ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে, সেই মাশরাফি যদি আমাদের এমপি হয়, সেটা আমাদের নড়াইলবাসীর সৌভাগ্য। নিশ্চয়ই নেত্রী মাশরাফিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেবেন।’

নৌকার প্রার্থী মাশরাফিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী উত্তেজনা বিরাজ করলেও বিএনপি জোটের প্রার্থী ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান এ জে এম ফরিদুজ্জামান ফরহাদের ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পুলিশের ধরপাকড় এবং হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। মাশরাফিকে নিয়ে যেখানে দুই উপজেলার ভোটাররা উৎসবে মেতে উঠেছে, সেখানে ধানের শীষের প্রার্থী ফরহাদ গতকাল সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিজ বাড়িতেই শুয়ে-বসে দিন কাটিয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রচারণায় নামার সুযোগ নেই। দিনে প্রচারণায় নামলে রাতেই পুলিশ অভিযান চালায় নেতাকর্মীদের বাড়িতে।’ বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ধানের শীষের প্রার্থীর পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে, প্রচারণায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছে, এনপিপির নেতার নামই অনেকে শোনেনি। মাশরাফির জনপ্রিয়তার কাছে ধোপে ঠিকছে না ধানের শীষ। প্রচারণায় বের হবে কিভাবে? দল-মত-নির্বিশেষে সবাই মাশরাফির নৌকার পক্ষে শামিল হয়েছে।

নির্বাচনী এলাকায় মাশরাফির ৫ পথসভা নিজ এলাকায় নতুনরূপে মাশরাফি। প্রতিনিয়ত নড়াইলে এলেও এবারের আসা অন্য রকম। সংসদ সদস্য প্রার্থী মাশরাফি এলেন সুসজ্জিত দলীয় প্রতীক নৌকায়। গতকাল ভোর থেকে নড়াইলের কালনা ঘাটে মানুষের অধীর অপেক্ষা। চারদিক থেকে সবাই ছুটছে কালনা ফেরিঘাটে। নড়াইলের ঘরের ছেলে আজ (গতকাল) বাড়ি ফিরে আসছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন।

দুপুর ২টায় কালনা ঘাটে নেমে একটি সাজানো নৌকায় নড়াইলে পৌঁছেন তিনি। এ সময় কয়েক হাজার মানুষের চাপে আর ভক্তদের ভিড়ে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন তিনি। কালনা ঘাট থেকে সড়কপথে স্ত্রী-সন্তান, বাবাসহ হাজারো ভক্তের সঙ্গে নড়াইলে পৌঁছেন তিনি। এরপর কালনা ঘাটে স্থাপন করা মঞ্চে এক পথসভায় অংশ নিয়ে নিজের দেরিতে পৌঁছার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

গাড়িবহর এগিয়ে চলে ধীরগতিতে। এরপর কয়েকটি পথসভায় অংশ নেন তিনি। লক্ষ্মীপাশা, এড়েন্দা, দত্তপাড়া ও নাকশীতে পথসভায় যোগ দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চান মাশরাফি। বিকেল ৫টায় নড়াইল পৌঁছে মাশরাফির গাড়িবহর। এরপর নড়াইল পুরনো টার্মিনালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া মাশরাফি বিন মর্তুজা। পরে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেতাদের সঙ্গে সভা করেন।

নৌকার দাপটে ‘জব্দ’ ধানের শীষ চেয়ারম্যানঘাটে গিয়ে দেখা গেল, মেঘনায় জল নেই, আছে শুধু জলকাদা। ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলো এই কাদাজলে ডুবে দুলছে। জোয়ারের আগে এই ঘাট আর জমবে না। কাঁচা ও ইটের পথ ধরে পাশের চটলা ঘাটে যেতে হলো। ঢেউ খেলতে দেখা গেল মেঘনার বুকজুড়ে। স্পিডবোট যাবে দক্ষিণ-পূর্বে। ১৭ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিলেই হাতিয়া দ্বীপ।

মো. মনির হোসেন দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে হাতিয়ার তুফাইন্না গ্রামে যাবেন। ভোটের পরিবেশ কেমন জানতে চাইলে বললেন, ‘সব আন্ধার, কিছু ন বুঝি।’ পাশের যাত্রী নহর আলী কানে কানে বললেন, ‘কেউ কিছু বলবে না হাতিয়ার রাজনীতি নিয়ে।’

নোয়াখালী জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে নোয়াখালী-৬ আসনটি হাতিয়া উপজেলা নিয়ে। এ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন আয়েশা ফেরদাউস। আর ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন ফজলুল আজিম। এ ছাড়া আরো ছয়জন প্রার্থী আছেন। এ আসনে ভোটার আছে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৫৪ জন।

সাত সকালে নোয়াখালী সদর থেকে সুবর্ণচর হয়ে হাতিয়ার হরনী ইউনিয়নের বয়ার চর বাজার পৌঁছে দেখা হলো জামাল উদ্দিন নামের এক গৃহস্থের সঙ্গে। ভোটের অবস্থা কী জানতে চাইলে বললেন, দরবেশ বাজারে আজিমের লোকদের পেটানো হয়েছে।

নলছিড়া ঘাট নামে পরিচিত এই ঘাটে শত শত মোটরসাইকেল ও অটোরিকশাচালক যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন। নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীর প্রচারের অবস্থা কেমন—জানতে চাইলে অটোচালক আবদুর রহিম বললেন, সব দলের প্রচার আছে। নৌকাও আছে, ধানের শীষও আছে, আছে হাতপাখা, লাঙলও।

পাকা পিচের সড়কের ওপর, গাছে, চান্দের গাড়ির গায়ে—সর্বত্র নৌকার পোস্টার। আফাজিয়া বাজার, চরকিং, চরঈশ্বর, সূর্যমুখী ঘাট, বুড়ির চর, সাগরিয়া বাজার ঘোরার পর দেখা গেল, আসলে প্রচারে আধিপত্য শুধু নৌকার। তাহলে অটোচালক যে বললেন সব প্রার্থীর প্রচার আছে? মোটরসাইকেলচালক শাহীন মিয়া তখন বললেন, ‘রাজনীতির ভেতর পলিটিকস ঢুকি গেছে।’

বিএনপির প্রার্থী ফজলুল আজিমের পোস্টার নেই, আপনারা নাকি তাঁকে প্রচারে বাধা দিচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে আয়েশা বলেন, ‘আজিম তো সাত বছর এলাকায় আসেননি। এখন বহিরাগত সাত-আট শ সন্ত্রাসী নিয়ে এলাকায় এসেছেন।’ আয়েশা দাবি করেন, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আজিম ২২ হাজারের বেশি ভোট জালিয়াতি করে জয়ী হয়েছিলেন। পরে আদালত তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছেন। তাঁর স্বামী তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনিও তিনবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে।

আয়েশার স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী বাড়িতেই ছিলেন। প্রচারের জন্য কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বাড়ির পাশের পার্কে বসে তিনি ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছি। ২০০১ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হলে খালেদা জিয়া শপথ নেওয়ার আগে আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর দলে যোগ দিতে বলেছিলেন। আমি পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিই।’

আয়েশার বাসার পাশেই সেতু। নাম দেওয়া হয়েছে ‘এমপির পুল’। সংসদ সদস্যের পোস্টার দেখতে দেখতে একই এলাকায় ফজলুল আজিমের বাড়ির সামনে পৌঁছলে চোখে পড়ে ধানের শীষের পোস্টার, দেয়ালে সাঁটানো। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে সাবেক সংসদ সদস্য আজিমকে পাওয়া গেল। তিনি দাবি করেন, তিনি গৃহবন্দি হয়ে আছেন। রাস্তায় বের হলেই আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা চালাবে। বিএনপির ১০৪ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আয়েশা ফেরদাউসের পক্ষে কাজ করছেন বলে তাঁর অভিযোগ।

আজিম বলেন, ‘আট দিন ধরে বের হতে পারছি না। প্রচারের পরিবেশ নেই। বলা হচ্ছে, কেন্দ্র দখল করা হবে। তাদের সামনে নৌকায় ভোট দিতে হবে। আমি তিনবার এমপি হয়েছি জীবনে।’ অবশ্য তিনি আয়েশার আনা ভোট জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ফজলুল আজিম ও তাঁর অনুসারীদের অভিযোগ, আয়েশার স্বামী মোহাম্মদ আলী ‘জলদস্যু সম্রাট’ ও এলাকার সন্ত্রাসীদের ‘গডফাদার’। আজিমের অভিযোগ, তাঁকে হত্যার জন্য মোহাম্মদ আলী লোক ভাড়া করেছেন।

ফজলুল আজিমের অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আজিম যাতে এলাকায় আসতে পারেন তার জন্য আমিই আমাদের কর্মীদের সহযোগিতা করতে বলেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘হাতিয়ায় আমি লাঠি ও সাধারণ মানুষ নিয়ে দেশবিরোধী ও জামায়াতীদের প্রতিরোধ গড়েছিলাম ২০১৪ সালে। আমার অবস্থানে বিরোধীরা ঈর্ষান্বিত হয়ে কলঙ্ক লেপন করতে চাচ্ছে।’

হাতিয়ার সুখচরের ভোটার রহমত আলী আজিমের দাবি মানতে চাইলেন না। তিনি বলেন, ‘বিএনপি প্রার্থী আজিম এমপি থাকাকালে প্রতিহিংসার রাজনীতি করেছেন। এখন বাড়িতে বসে থেকে ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ের কৌশল নিয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। সত্যিই হাতিয়ায় পলিটিকস বোঝা কঠিন হয়ে গেছে।’ দ্বীপের সংখ্যালঘু ভোটার ও নীরব ভোটাররা বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।

হাতিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামান শিকদার বলেন, ‘হাতিয়ার পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আজিম সাহেব সাহায্য চাইলে আমরা প্রস্তুত আছি। তিনি কোথাও বের হন না। আমাদের কর্মসূচিও জানান না। যেদিন তিনি হাতিয়ায় এসেছেন তাঁকে সেদিন আমরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি।’

নীরবতা ভেঙেছে বিএনপি, জোর প্রচারে আ. লীগ রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, রামপুরা ও হাতিরঝিল থানার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১১ আসনে নীরবতা ভেঙে প্রচারণা চালিয়েছে বিএনপি। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে শনিবার খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় মিছিল ও জনসংযোগ করেছেন ধানের শীষের প্রার্থী শামীম আরা বেগম। তিনি এত দিন দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের অভিযোগ করে এলেও গতকাল বিএনপির মিছিল এবং জনসংযোগ থেকে কোনো নেতাকর্মী গ্রেপ্তার বা হয়রানির শিকার হয়নি।

এদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং টানা দুইবারের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ্ আরো জোরদার করেছেন এই সংসদীয় এলাকায় তাঁর প্রচারণা। জনসংযোগ ও প্রচারণা চালানোর স্বীকৃত সব কটি মাধ্যমই ব্যবহার করেছেন তিনি। মাইকিং, জনসংযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, মিছিল ও জনসমাবেশ করে ভোট চাওয়া হচ্ছে নৌকার পক্ষে। গতকাল মিছিল ও জনসমাবেশ করেছে ভাটারা ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগ, যেখানে অনেক নারী কর্মীকে দেখা গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ধানের শীষের প্রার্থী শামীম আরা বেগম সকাল সাড়ে ১১টায় কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে তালতলা বাজার এলাকায় যান। তালতলা বাজার থেকে মিছিলটি কবরস্থান সড়ক হয়ে রিয়াজবাগ আবাসিক এলাকায় যায়। এ সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা লিফলেট বিলি করে ধানের শীষের জন্য ভোট চায়। রামপুরা থানা পুলিশের একটি টহল ভ্যান মিছিলের পেছনে ছিল। এ সময় কোনো নেতাকর্মী বা সমর্থককে হয়রানি বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়নি।

শামীম আরা বলেন, ‘আর বসে থাকার সুযোগ নেই। নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। কোনো গ্রেপ্তার বা হয়রানি হয়নি মিছিলে।’

এলাকাবাসী জানায়, গত ১০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার পর বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর কোনো মিছিল বা জনসংযোগ দেখা যায়নি। ব্যানার বা পোস্টার সাঁটায়নি দলটির কোনো কর্মী। বিএনপির মিছিলটি তালতলা বাজার পার হওয়ার সময় সেখানে মাইকে বাজছিল নৌকার প্রার্থী এ কে এম রহমতুল্লাহেক নিয়ে তৈরি করা গান। নৌকার সমর্থকরাও ছিল বাজারেই। কিন্তু কোনো ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বা বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এলাকাবাসী।

রিয়াজবাগ এলাকার ভোটার ইয়াসিন আল মাসুম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা নিয়মিত দেখলেও আজ প্রথম দেখলাম বিএনপিকে। কোনো পোস্টার বা ব্যানারও নেই ধানের শীষের। তবে বড় দুই দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোট হোক, আমরা তা চাই।’

রামপুরা বাদে বাড্ডা ও ভাটারা থানায় বিএনপির কোনো মিছিল বা জনসংযোগ দেখা যায়নি। এ ছাড়া পুরো এলাকায় নির্বাচনী ক্যাম্প বা অফিসও দেখা যায়নি দলটির।

এদিকে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ভাটারা থানার কুড়িল এলাকায় মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। মিছিল শেষে এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে নৌকার লিফলেট। ঢাকা-১১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম রহমতুল্লাহ্র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করছে বাড্ডা, রামপুরা ও ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। রামপুরার বনশ্রী আবাসিক এলাকা, উত্তর বাড্ডার হাছান আলী রোড এবং ভাটারার নতুন বাজার, ছোলমাইদে নারীদের সমন্বয়ে দল গঠন করে প্রচারণা চালানো হয়েছে এ কে এম রহমতুল্লাহ্র পক্ষে।

ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসহাক মিয়া বলেন, ‘শনিবার ভাটারা থানায় নৌকার পক্ষে মিছিল ও গণসংযোগ করেছি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ব্যস্ত থাকার কারণে সব সময় জনসংযোগে থাকতে পারেন না। তাই থানা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সব এলাকায় দল গঠন করে নিয়মিত প্রচারণা ও জনসংযোগ চালানো হচ্ছে।’

বাড্ডা থানার খিলবাড়িরটেক এলাকায় জনসমাবেশ করেছেন এ কে এম রহমতুল্লাহ্। সমাবেশে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং বাড্ডা ও ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিল। জনসভায় এ কে এম রহমতুল্লাহ্ বলেন, ‘আমি এই এলাকার সন্তান। সর্বশেষ দুই নির্বাচনে আপনারা আমাকে নির্বাচিত করে এলাকাবাসীর পাশে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। গত ১০ বছরে দেশে দৃশ্যমান উন্নয়নের সাক্ষী আপনারা। বঙ্গবন্ধু কন্যার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আবারও আপনারা নৌকার ভোট দিয়ে আপনাদের পাশে থাকার সুযোগ দেবেন।’