অনলাইন ডেস্ক: নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া কালিকুমার ইনস্টিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজের পিছনে দুই কক্ষের একটি বাড়ি। ইটের গাথুনি থাকলেও প্রলেপ না পড়ায় অনেকটা শ্রীহীন। ঘরে প্রবেশ করলেই দারিদ্রতার মলিন চিত্র চোখে পড়ে। বিছানার পাশে মায়ের জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার সেলাই মেশিন। আর পাশের কক্ষটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা লেখকের বই। অথচ শ্রীহীন এই বাড়ির ছেলে শামীম আহমেদ জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে সারা দেশে।
বেসরকারি টেলিভিশন ইন্ডিপেনডেন্ট’র বাংলাদেশ জিজ্ঞাসা প্রতিযোগীতায় ৮০ হাজার প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে হয়েছেন দেশ সেরা। চ্যাম্পিয়ন হয়ে জিতে নিয়েছেন এক কোটি টাকা। নিজের সঙ্গে আলোকিত করেছেন নরসিংদীকে। নিজ কলেজের ছাত্র বিজয়ী হওয়ায় উচ্ছাস্বিত নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, চরম দারিদ্রতার মধ্যেও ইচ্ছাশক্তি, মনের জোর, চেষ্টা ও কঠোর অধ্যাবসায় থাকলে যে সাফল্য অর্জন করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শামীম আহমেদ। সংঘাত, টেঁটাযুদ্ধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রায়ই নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয় নরসিংদী। এরই মধ্যে শামীমের সাফল্য কলেজ তথা নরসিংদীবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছে।
শামীম আহমেদের গল্পের কথা শুনতে মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিন’র নরসিংদী প্রতিনিধি যায় শহরের দক্ষিণ সাটিরপাড়ায় তার বাড়িতে। বাবা আবদুল মোমেন ইউএমসি জুট মিলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক। মেঝো ভাই সাইফুল ইসলাম সজিব ট্রেন দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছেন। আর ছোট ভাই সফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের স্মাতকের ২য় বর্ষের ছাত্র।
শত অভাব অনটনে শামীমের মা সামসুন নাহার দিনরাত সেলাই কাজের মাধ্যমে নিরলস পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরেন। শামীম নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছে। এরই মধ্যে বয়সের ভারে ন্যুজ বাবা ইউএমসি জুট মিল থেকে অবসরে যায়। তাই এসএসসি পরীক্ষার পর থেকেই শামীম টিউশনী শুরু করে। তবে জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাওয়া শামীম অদ্ভুত এক নেশায় মগ্ন। সেই নেশা হলো বইয়ের। পত্রিকা আর বিভিন্ন লেখকের বই পড়া তার ছিল দৈনন্দিন রুটিন।
এরই মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে শামীম জানতে পারেন ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের বাংলাদেশ জিজ্ঞাসা প্রতিযোগীতার কথা। ৮০ হাজার প্রতিযোগী থেকে বাঁছাই করা ৬৪ জন প্রতিযোগী নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় চুড়ান্ত প্রতিযোগীতা। প্রতিযোগীতার ৪টি রাউন্ডের মধ্যে তিনটিতে হয়েছেন সেরা স্কোরার। চুড়ান্ত প্রতিযোগীয় প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো মহান বিজয় দিবসের রাতে। কোটি টাকা উঠলো বিজয়ী শামীম আহমেদের হাতে। সঞ্চালক খালিদ মুহিউদ্দীনের শেষ প্রশ্ন-পর্ব বাজান রাউন্ডের সমাপনীর সঙ্গে সঙ্গে নরসিংদীর ছেলে শামীমের স্কোর দাঁড়ায় ১১৫।
বিজয় নিশ্চিত হলে মে ছুটে এসে পুত্রকে জড়িয়ে ধরে আবেগ কেঁদে ফেলেন শামীমের মা। বিজয়ীর হাতে কোটি টাকার চেক তুলে দেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়ার পর শামীমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে নরসিংদী তথা দেশব্যাপী। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোক বাড়িতে গিয়ে শামীমকে অভিনন্দন জানান। যা দারিদ্রজয়ী শামীমের মা-বাবাকে মুগ্ধ করে। স্থানীয় শিক্ষক শাহরুখ ইশতিয়াক খাঁন বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই অর্জন তার জীবনে অনাগত অসংখ্য সাফল্যের সূচনা মাত্র। নিজের অনুভূতি জানতে চাইলে শামীমের মা সামসুন নাহার বলেন, ২০ বছর সেলাই কাজ করার সেই কষ্ট আজ স্বার্থক হয়েছে। এখন স্বপ্ন দেখি আমার ছেলে ভাল একটি চাকুরি করবে।
শামীমের বাবা আবদুল মোমেন বলেন, শামীম এই বয়সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে দেশের সেরা হয়েছে। আমরা তাকে আরও ভাল জায়গায় দেখতে চাই।
শামীম আহমেদ বলেন, আমি ছিলাম মধ্যম মানের ছাত্র। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী পাওয়ার পর লক্ষ্য ছিল বিসিএসের। সেই কারণে টিউশনীর বাকী সময়টুকু আমি লাইব্রেরীতে কাটিয়েছি এবং ট্যাবে ইন্টারনেটে বই পড়েছি। আর সেই কঠোর পরিশ্রমের কারণেই আজ আমি বাংলাদেশ জিজ্ঞাসা প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছি। আমি আশাবাদী সবার দোয়া ও ভালবাসা নিয়ে অনেক দূর যেতে পারবো। একই সঙ্গে শামীম গরীব কিন্তু পড়াশুনায় আগ্রহ আছে সে সকল অদম্য মেধাবীদের পাশে দাঁড়াতে চায়।