অনলাইন ডেস্ক: বিদেশি বিনিয়োগকারী ও নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো ও শিল্পবান্ধব হয়েছে বলে মনে করে ভারত। বিশেষত, ভারতের যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের এভাবেই আশ্বস্ত করা হয়েছে।
ভারতের এনটিপিসি, রেল কিংবা ওএনজিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং টিসিএস, এমএন দস্তুরের মতো বিভিন্ন সফটওয়্যার ও প্রকৌশলী সংস্থা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পে যুক্ত। এসব প্রকল্পে তাদের কারও কারও বিপুল অঙ্কের লগ্নিও রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় এই সংস্থাগুলোকে ‘ব্রিফ’ করতে গিয়ে ভারত সরকার আশ্বস্ত করে বলেছে, ভোটের কারণে তাদের শিল্পগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং কোনও নির্বাচনি সহিংসতার আঁচ এই প্রকল্পগুলোকে স্পর্শ করবে না বলেই ভারত সরকার মনে করে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারতের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)। ওই সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ খবর নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারত সরকার আমাদের পরিষ্কার বলেছে, বাংলাদেশে লগ্নি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিস্থিতি যে আগের চেয়ে অনেক ভালো, সেটাও উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’
তবে, তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে যখন বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের ওপর আক্রমণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালানো হয়, তখন ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু ভারত সরকার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রথমত হলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশ সরকারের কঠোর জঙ্গীবিরোধী অবস্থানের কারণে আর কোনও বড় ধরনের হামলা ঘটতেই পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিএনপি আমলে যেখানে ভারতের টাটা বা সাহারা শিল্পগোষ্ঠীর মতো বৃহৎ সংস্থাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিল, সেই জায়গায় এখন শতাধিক ভারতীয় সংস্থা বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় প্রকল্পে কাজ করছে।’
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রদূত মি. চৌধুরী যখন সিলেটে শাহ জালালের মাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখন জঙ্গিরা তাকে হত্যার চেষ্টা করে। পরে গত বছরের এপ্রিলে ওই হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ওই ঘটনার দৃষ্টান্ত টেনে ভারত সরকার তাদের দেশের শিল্প সংস্থাগুলোকে বলেছে, ‘খোদ রাষ্ট্রদূতের জীবনের ওপর হামলার পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগও ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সরকার ও সে দেশের লগ্নিকারীরাও আবার বাংলাদেশে ফিরে আসছেন।’
ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস কোম্পানি ওএনজিসি-র সহযোগী সংস্থা ‘ওএনজিসি বিদেশ’-ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশের দু’টি ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে ‘স্টেক’ আছে, এমন ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য দিল্লিতে গত সপ্তাহে আয়োজিত ওই বিশেষ সরকারি ‘ব্রিফিং’য়ে উপস্থিত ছিলেন ওএনজিসি বিদেশের কর্তারাও। তাদেরই একজন জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি রীতিমতো সন্তোষজনক বলে মনে করলেও জামায়াতের মতো সংগঠনগুলো যে নাশকতা চালানোর চেষ্টা করতে পারে, সেটাও অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছে।’ আর এ প্রসঙ্গেই আলোচনায় এসেছে মার্কিন কংগ্রেসে ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি ও রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ জিম ব্যাঙ্কসের পেশ করা সাম্প্রতিক প্রস্তাবের প্রসঙ্গও।
গত ২০শে নভেম্বর কংগ্রেসে পেশ করা ওই প্রস্তাবে (হাউস রেজলিউশন ১১৫৬) জিম ব্যাংকস সোজাসুজি বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত ও সমমনা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রর জন্য প্রধান বিপদ।’ বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন হামলার ঘটনাতেও তিনি সরাসরি দায়ী করেছেন জামাতকেই। তার ওই প্রস্তাবটি এখন মার্কিন কংগ্রেসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক কমিটির বিবেচনার জন্য রেফার করা হয়েছে। পরে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসি-তে স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক হাডসন ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ বিষয়ক এক আলোচনাসভাতেও তিনি অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন।
সেখানেও জিম ব্যাংকস বলেন, ‘‘দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি ‘বুমিং ডেমোক্র্যাসি’, সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তাদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোই সে দেশের সমৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা!’
ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলোর জন্য আয়োজিত দিল্লির ব্রিফিংয়েও রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাংকসের এই মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর সেখান থেকে সর্বসম্মতভাবে এই অভিমতই উঠে এসেছে যে বিগত বিএনপি আমলের তুলনায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও শিল্প পরিবেশ এখন অনেক অনেক বেশি ভালো। তবে, জামায়াতের মোকাবিলাই সম্ভবত এখনও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ!