দেশের খবর: জামায়াতকে ২২টি আসনে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ার কারণে বিএনপি জোট এবারও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন হারিয়েছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পাশাপাশি পর্যবেক্ষক মহলেও। পাশাপাশি বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার কোনো প্রতিশ্রুতি না থাকার বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর অনেক নেতা বলছেন, অনেকটা নমনীয় হয়েও শুধু জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়ার কারণেই ভারত শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে সমর্থন করেনি। আর ক্ষমতায় থাকতে ঢাকায় তাইওয়ান সেন্টার নির্মাণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অবিশ্বাস পুরোপুরি দূর না হওয়ায় পক্ষে আনা যায়নি শক্তিধর দেশ চীনকেও। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে। ওই রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের অনেকেই অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগও এ ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। ফলে নির্বাচনের পরদিনই চীন ও ভারত প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক না কেন, নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার এক ধরনের স্বস্তি পেয়েছে। অথচ ভারত ও চীনের কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে পাঁচ বছর ধরেই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে আসছিল বিএনপি। আর ভারতের সমর্থন পাওয়া যাবে—এমন আশাবাদও এবার তৈরি হয়েছিল দলটির মধ্যে। কিন্তু পর পর দুটি নির্বাচনে (২০০৮ ও ২০১৪) ভারতের সমর্থন আদায়ে বিএনপি ব্যর্থ হওয়ার পর এবারও কেন এমন হলো সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জামায়াতকে নিয়ে আপত্তির কথাই জানা গেল। এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের পাশাপাশি বিএনপি জোটের নেতাদের মূল্যায়নও প্রায় একই রকম। যদিও জোট থেকে জামায়াতকে বের করে দিলেও বিএনপিকে ভারত সমর্থন করত কি না, তা নিয়ে দ্বিমত আছে বিএনপির অনুসারী বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ভারত বা চীন যে একটি দলের পক্ষে সরাসরি কাজ করেছে এমন নয়। তবে এটি ঠিক যে জামায়াতকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা বিএনপির মধ্যেও আছে। তবে বিএনপি কেন জামায়াতকে ধরে রেখেছে, এটা বলা মুশকিল।’
নির্বাচনের আগে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান ছিলেন দলটির তখনকার ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহম্মেদ চৌধুরী। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ইনাম আহম্মেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি সত্যি কথা যে জামায়াতকে আসন ছেড়ে দেওয়াটা অনেকে পছন্দ করেনি এবং সম্ভবত ভারতও করেনি। তাঁর মতে, এ ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে; বিএনপির কিছুটা ক্ষতিও হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জামায়াতকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদ ছাড়াও অন্য কয়েকটি কারণ রয়েছে বিএনপি থেকে তাঁর পদত্যাগের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জামায়াতকে ২২টি আসনে ধানের শীষ মার্কা দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের ঘোর আপত্তি ছিল। লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এর ‘সমূহ বিপদ’ সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল বলেও দাবি করেন তাঁরা। বিশেষ করে ভারতের আপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে ওই নেতারা জামায়াতকে মার্কা না দিয়ে শুধু তাঁদের কিছু আসনে বিএনপির প্রার্থী না দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, আসন বণ্টনের বৈঠকেও বিএনপি নেতারা বিষয়টি জানিয়েছিলেন জামায়াতকে। ওই বৈঠকে আসনসংখ্যা নিয়ে তর্কবিতর্কের পাশাপাশি মার্কা নিয়েও বিতণ্ডা হয়। কিন্তু জামায়াত তখন লন্ডনের সম্মতি আদায় করে শেষ পর্যন্ত ধানের শীষ প্রতীক পেতে সক্ষম হয়। যদিও আসনসংখ্যা নিয়ে অসন্তুষ্টির কারণে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তও জামায়াত একপর্যায়ে নিয়েছিল বলে জানা যায়। তবে বিএনপির অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশ নেয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘জামায়াতের কোনো নিবন্ধন নেই। ফলে তাদের মনোনয়ন কিভাবে দিলাম? মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে কোনো জামায়াত নেই।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, জামায়াতের কারণে ভারত রুষ্ট কি না, তা তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে ভারতের কেউ ভালো বলতে পারবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে নিয়ামক ভূমিকা পালনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, জামায়াতকে মনোনয়ন দেওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিএনপির ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও জামায়াতভীতির কথা বোঝানো হয়েছে। তা ছাড়া জামায়াতকে ২২টি আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপি আলোচনাও করেনি। এটাও ঠিক হয়নি। তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে একটি লাইন থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো! তা ছাড়া দুটি ইশতেহারও দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলনা।’
তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য আবদুল হালিম মনে করেন না যে জামায়াতকে নির্বাচন করতে দেওয়ার সুযোগে ভারত রুষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি বিএনপি মনে করতে পারে, কিন্তু আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শরিক অন্য দলগুলোকে যেভাবে ধানের শীষ মার্কা দেওয়া হয়েছে, বিএনপি আমাদেরকেও সেভাবেই মার্কা দিয়েছে। এটি বিএনপির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হয়েছে।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘জামায়াতকে মনোনয়ন দেওয়ায় আমাদের ক্ষতি হয়েছে তো বটেই! আমরা সেট ব্যাকে গেলাম! তা ছাড়া তারা তো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকল না। নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা (জামায়াত) নির্বাচন বর্জন করল। তারা বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট কারো সিদ্ধান্ত মানেনি। অথচ আমরা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ থাকলে ভালো হতো। তবে এটা ঠিক; জামায়াতকে আসন ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে।’
জানা গেছে, নির্বাচনের পরদিনই ভারত ও চীনের অভিনন্দন জানানোর ঘটনায় অনেকটাই বিস্মিত হয়েছে বিএনপির মিত্র দলগুলো। কারণ নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে রাখার ঘোর বিরোধী ছিল ঐক্যফ্রন্টের অন্য দলগুলো। ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিও ছিল। ফলে জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে দু-একটি দলের নেতা প্রশ্নও তুলছেন। নির্বাচনের পরদিন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী উপস্থিত বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চান, জামায়াতকে ২২টি আসনে কেন মনোনয়ন দেওয়া হলো? জবাবে বিএনপি নেতারা কৌশলী জবাব দিয়ে বলেন, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট আলাদা। নির্বাচনের আগে মিত্র দলগুলো এ নিয়ে কথা না বাড়ালেও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।