জাতীয়

বিদেশে প্রশিক্ষণের ফল শূন্য!

By daily satkhira

January 05, 2019

অনলাইন ডেস্ক: সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জনগণের করের শত শত কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে প্রশিক্ষণ নিলেও তা কোনো কাজে আসছে না। কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই প্রকল্প নেওয়া হলেও তার ফল কার্যত শূন্য বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে তাদের অর্জিত জ্ঞান বিফলে যাচ্ছে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখনও বিদেশি পরামর্শকদের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের গত দশ বছরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন দুই হাজার ৪৫১ জন বিসিএস কর্মকর্তা। এ জন্য সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কোনো সুফল মেলেনি। কারণ, কর্মকর্তারা যে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন, সে কাজে তাদের পদায়ন করা হয়নি। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের কার্যক্রম মনিটরিংও করা হচ্ছে না। এসব কর্মকর্তা বড় প্রকল্পে পদায়ন পেলেও শেষ পর্যন্ত বিদেশি পরামর্শকদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী খাতভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরির জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা জরিপও নেই। প্রশিক্ষণে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও এ জন্য সরকারের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে কর্মকর্তারা যে উদ্দেশ্যে ওই ডিগ্রি নিয়েছেন, তার ফল শূন্য। দক্ষ প্রশাসন গড়ার সরকারের উদ্যোগটি ভেস্তে যাচ্ছে।

যেমন সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন ক্যাডারের) সোহেল পারভেজ, হুমায়ূন কবির, মমিন উদ্দিন ও টেলিকম ক্যাডারের সাইফুল ইসলাম প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু তাদের প্রথম দু’জনকে পদায়ন করা হয়েছে মাঠ প্রশাসনে। মমিন উদ্দিনকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) এবং সাইফুল ইসলামকে বিটিসিএলের উপব্যবস্থাপক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।

সিনিয়র সহকারী সচিব চৌধুরী আশরাফুল করিম মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও অর্থ ব্যবস্থাপনা, দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং তানজিল্লুর রহমান পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে।

অথচ তাদের সবাইকে পদায়ন করা হয়েছে মাঠ প্রশাসনে। সিনিয়র সহকারী সচিব মহসিন মৃধা ডিগ্রি নিয়েছেন আন্তর্জাতিক আইনে। তাকে পদায়ন করা হয়েছে এটুআই প্রকল্পে। আরও শতাধিক কর্মকর্তা ডিগ্রি নিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, তথ্যপ্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে। অথচ তাদের পদায়ন করা হয়েছে সংস্কৃতি, শ্রম, ধর্ম ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। একই ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তাও কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কাজ করছেন বিভিন্ন দপ্তরে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করা বিটিসিএলের উপব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, যিনি যে বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন, তাকে সে বিষয়ে পদায়ন করা হলে তা কার্যকর হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিনিয়র সহকারী সচিব মহসিন মৃধা বলেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশ-বিদেশের উচ্চতর প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া কর্মকর্তাদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করতে হলে অবশ্যই প্রশিক্ষণ সংশ্নিষ্ট বিষয়ে পদায়ন করা দরকার। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা এ সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে কোনো বিষয় জানা থাকলে যে কোনো মুহূর্তে তা কাজে লাগবে।

জানা যায়, গত দশ অর্থবছরে (২০০৯-২০১৮) বিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদেশে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন ৫৭৭ জন, ডিপ্লোমা ১৫৭ জন ও সংক্ষিপ্ত কোর্স করেছেন এক হাজার ৭১৭ জন। এর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যের হার্ভার্ড, ডিউক, আইটিসি-আইএলও, ম্যাকক্যারি, কার্টিন, সাসেক্স, অক্সফোর্ড ও বার্মিংহাম এবং আমেরিকা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়ার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এ খাতে গত দশ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০২২ সাল পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় করার জন্য আরও প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ সময় মাস্টার্স ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন নবীন কর্মকর্তারা। আর শর্ট কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিবরা।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের প্রশিক্ষণ কতটা কাজে লাগাচ্ছেন তা তদারকি কিংবা এ নিয়ে জরিপ সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে অর্জিত ডিগ্রিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক মুয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, কোন খাতের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার সেটা আমাদের জানা আছে। এ জন্য কোনো জরিপের প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া মাস্টার্স ও ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের সংশ্নিষ্ট বিষয়ে পদায়ন করা হয়। সংক্ষিপ্ত কোর্স ততটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

জানা গেছে, শত শত কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও দেশের বড় প্রকল্পগুলোতে নিয়োগ করা হচ্ছে বিদেশি পরামর্শক। কিছু কর্মকর্তা প্রকল্প সংশ্নিষ্ট কাজে পদায়ন পেলেও মূল দায়িত্বে থাকেন বিদেশি পরামর্শকরা। এতে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হতাশায় ভুগছেন। এ ছাড়া দেশের উন্নয়ন কাজের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অথচ তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ কম। কারণ, সরকার বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের জন্যই ৭০ ভাগ আর অন্যান্য ক্যাডারের জন্য মাত্র ৩০ ভাগ কোটা বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের উদ্দেশ্য হলো সব সেক্টরকে এগিয়ে নেওয়া।

বিটিসিএলের উপ ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনে কোটা পদ্ধতি বাদ দিয়ে মেধা পদ্ধতি চালু করা দরকার।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম বলেন, সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজে লাগালে দেশের মঙ্গল হতো। এ জন্য অবশ্যই মহাপরিকল্পনা, জরিপ ও তদারকি দরকার। এ ছাড়া খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য সংশ্নিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে ক্লাস্টার পদ্ধতি চালু করতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও ট্রেনিং (সিপিটি) বিভাগ শুধু এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে। তবে সিপিটি বিভাগ হয়তো জনবলের অভাবে কাজ করতে পারছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে বহুমুখী প্রশিক্ষণ তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এ ধরনের প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে বিশেষায়িত উৎকর্ষ উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো- যারা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কর্মপরিধি প্রশিক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কোনো সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার আছে বলে জানা নেই। থাকলেও প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের কোনো পথরেখা নেই। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এ ধরনের কৌশল ও তা বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।

দেখা গেছে, একজন কর্মকর্তা ছয় মাস ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কাজ করার পর তাকে পদায়ন করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বছর দুয়েক থাকার পর পদায়ন করা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। এতে কোনো খাতেই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা তৈরি হচ্ছেন না।