দেশের খবর: নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার মূল অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ সাতজনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে থেকে রুহুলের রয়েছে অনেক ‘গুণ’। বনদস্যু ও জলদস্যুদের নিয়ে রয়েছে তার ‘রুহুল আমিন বাহিনী’। কোনো যোগ্যতা ছাড়াই সে পেয়েছে আওয়ামী লীগের মতো দলের স্থানীয় নেতার পদ। তাকে নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, গণধর্ষণের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত রুহুল আমিন এক সময় ‘হোটেল বয়’ হিসেবে কাজ করত। অযোগ্য ও নানা অপরাধে অভিযুক্ত লোকদের আওয়ামী লীগে বড় পদ দেওয়ার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। এদিকে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূকে শনিবার নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড থেকে ভিআইপি কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। কেবিনের ভেতরে নারী পুলিশ সদস্য ও বাইরে পুরুষ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। অনুমতি ছাড়া কাউকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরিফ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসারত আহত নারীর নিরাপত্তার জন্য দু’জন নারী ও দু’জন পুরুষ পুলিশ সদস্যকে সব সময়ের জন্য রাখা হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের ঘটনার ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে তারা। এখন সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গ্রেফতার সোহেল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ৩০ ডিসেম্বর রাতে বর্বরোচিত ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। নোয়াখালী গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিদর্শক জাকির হোসেন জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল বলেছে- তারা ৯ জন মিলে পালাক্রমে ওই গৃহবধূর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তারা ওই গৃহবধূর শিশুকন্যাকে (১৪) খুঁজতে থাকে। কিন্তু শিশুটি কৌশলে পালিয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পুনরায় তার ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর ওই নারীকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং কামড়িয়ে শরীরের ২২ স্থানে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। একপর্যায়ে তাকে মৃত ভেবে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়।
এদিকে, গণধর্ষণের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত রুহুল আমিনের মতো লোক সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ কীভাবে পেল তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। দলীয় ফোরামে অনেকে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করলেও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও চরজুবলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ চৌধুরী তার পক্ষ নেওয়ায় ওই প্রতিবাদ টেকেনি। শুরু থেকেই হানিফের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রুহুল আমিন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১১ সালে ৫ নম্বর চরজুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়াডের্র ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয় রুহুল আমিন। এরপর সে এলাকায় অপরাধের রাজত্ব কায়েম করে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের সংগঠিত করে নিজের নামে গড়ে তোলে ‘রুহুল আমিন বাহিনী’।
স্থানীয়রা জানান, লক্ষ্মীপুরের রামগতির চরাঞ্চলের লাঠিয়াল খুরশিদ আলমের ছেলে রুহুল আমিন। তার বাবাও ছিলেন হত্যা মামলার আসামি। ১৯৮০ সালে বেচু হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন খুরশিদ। রুহুল আমিন ছোটবেলায় হারিছ চৌধুরী বাজারে রাহিন-মাহিন হোটেলে বয়ের কাজ করত। কিছু দিন কাজ করার পর জেলা শহর মাইজদীর একটি বাসায় কাজ নেয়। এরপর সুবর্ণচরের পাংখার বাজারে সততা নামে একটি স্থানীয় এনজিওতে চাকরি নেয় রুহুল। অভিযোগ রয়েছে, ওই এনজিওর ৭০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে রুহুল আমিন ঢাকায় চলে যায় এবং রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পাইকারি সবজি দোকানে কাজ নেয়। সেখান থেকেও বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে বরিশাল চলে যায়। পরে নোয়াখালীর মাইজদীতে এক আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। মূলত এ সময়ই নিজ এলাকার লোকজনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে রুহুল আমিন।
২০০৯ সালে চরজুবলী ইউপি চেয়ারম্যান হানিফের সহায়তায় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ওয়ার্ড সম্পাদকের দায়িত্ব পায়। ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নম্বর চরজুবলী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়। পরে তাকে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক করা হয়। তবে ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে সদস্য হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে হেরে যায় রুহুল।
সরেজমিন দেখা যায়, রামগতি-চরজব্বার সড়কের পাংখার বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে তার নামে গড়ে তোলা হয়েছে রুহুল আমিন নগর। একটু এগিয়ে গেলেই খালের ওপর সেতু, তারপর প্রশস্ত সড়ক। সেই সড়কপথে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে রুহুল আমিনের বিলাসবহুল বাড়ির প্রবেশপথ। তার নগরে আছে একটি ইটভাটা, দোকানপাটসহ কয়েকটি ঘর। চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ইউপি চেয়ারম্যান হানিফের আশ্রয়ে থাকায় কেউই তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, সুবর্ণচরের রাজনীতি সব সময়ই পরিচ্ছন্ন ছিল। এখানে সব দলের সহাবস্থান আছে। দলীয় মতপার্থক্য থাকলেও কেউ কারও ক্ষতি করেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে সুবর্ণচরের রাজনীতি কলুষিত হয়ে গেছে। বহিরাগত ও অযোগ্য লোকদের নেতা বানিয়ে রাজনীতিকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে।
তবে এসব বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ ন ম খায়রুল আনম সেলিম বলেন, রুহুল আমিন এক সময় বিএনপি করত। পরে যখন সে সুবর্ণচরে বসবাস শুরু করে, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ করা শুরু করে। আওয়ামী লীগ একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হওয়ায় এখানে অনেকেই যোগ দিয়েছে। আমরা যখনই দলের লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের কাছে দলীয় পরিচয় বড় নয়, অপরাধী আমাদের দলের হলেও তাকে শাস্তি পেতে হবে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করছি।
শুক্রবার রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৪ আসনের (সদর-সুবর্ণচর উপজেলা) সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর নির্দেশে সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি দল নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ওই নারীকে দেখতে যায়। এ সময় তারা সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকার সহায়তা দেন। এ ছাড়া চিকিৎসা, আইনি সহায়তা, পুনর্বাসন এবং সন্তানদের চাকরির আশ্বাস দেন।