দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় সিনেমা তারকা রজনীকান্তর ছবি অনেক ভারতীয়ের পূজার ঘরে দেবদেবীর পাশে বাঁধানো থাকে। অনেকে তাঁকে অবতার ও দেবতাজ্ঞানে পূজা করেন। অনেক ঘরে দিন শুরুর আগে দুধ দিয়ে ধোঁয়া হয় রজনীর কাচে বাঁধানো ছবি। একসময় এসব শুনে ভাবতাম, বানোয়াট গল্প ও মিথ। সম্প্রতি নানা নির্ভরযোগ্য তথ্য হাতড়ে নিশ্চিত হয়েছি এসব শুধু সত্যিই নয়, রজনীভক্তির ধরনধারণ ও মিথ আসলে কল্পনারও অতীত। তাঁকে নিয়ে অগণিত বই লেখাই নয়, সমাজবৈজ্ঞানিক আলোচনা আছে। একটি পিএইচডি গবেষণা আছে ‘সিনেম্যাটিক ক্যারিজমা অ্যাজ অ্যা গেটওয়্যে টু সাউথ ইন্ডিয়ান পলিটিক্স’ যার বেশির ভাগ বিশ্লেষণই রজনীকেন্দ্রিক।
২০১৬–এর ডিসেম্বরে ‘রজনী মাক্কাল মান্দ্রাম’ (রজনীভক্তকুল সমিতি) রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মাও সেতুংয়ের ‘রেড বুক’ আদলে রজনী ৩৬ পৃষ্ঠার ‘ব্লু বুক’ ছাপেন। রাজনৈতিক নীতিমালা, আচরণবিধি, দেশ চালানোর দর্শন, বাণী ইত্যাদি গ্রন্থিত হওয়া বইটির অসাধারণ কাটতি। প্রতি মাসেই ছাপতে হচ্ছে বইটি। বইটির প্রচ্ছদে ছাপা রজনীর সন্ত-দার্শনিক ভঙ্গির ছবিটিরও পোস্টকার্ড হয়েছে। দারুণ বিক্রিবাট্টাও চলছে। তাঁর সাধু-সন্তদের মতো লম্বা দাড়ি-পাগড়িশোভিত ছবির চারপাশে ঠিকরে পড়ছে আলো—এ রকম বানোয়াট ফটোশপকৃত পোস্টারও কিনছে আমজনতা।
অদ্ভুত, অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব ও উদ্ভট ক্যারিকেচারের মারামারি, অতি-অভিনয় এবং বিচিত্র চালচলন দেখিয়েও রজনীকান্ত ‘সুপারস্টার রজনী’ বা দেবতা-ইমেজের মানুষই হননি, আগামী নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ‘ফ্রম সুপারস্টার টু সিএম? রজনীকান্ত মেইক্স হিজ ডেব্যু অ্যাজ পলিটিশিয়ান’ শিরোনামের একটি লেখা বহুলপঠিত রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার জায়গা করে নিয়েছে।
কিন্তু কীভাবে? রজনীকান্তকে কারা প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়? তাঁর পূজা কারা দেয়, পোস্টার কারা কেনে? কেন এই উন্মাদনা? উত্তর—এরা সবাই অতিসাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের আমরা ‘আমজনতা’ বলি। রজনীর বই, কার্ড, পোস্টার, বাঁধানো কাচে ছবি ইত্যাদির পেছনে পয়সা খরচ করতে গিয়ে তাদের পকেটে এবং জীবনযাপনে চাপ পড়লেও মনপ্রাণ উৎফুল্ল হয়। সিনেমায় যেমন রজনী গরিবের বন্ধু, অন্যায়–অবিচারের বিনাশক, অসহায়ের ত্রাতা, আশ্রয়হীনের আশ্রয়, নির্ভরতার প্রতিভূ—সমাজজীবনেও আমজনতা রাজনীতিকদের ত্রাতার ভূমিকায় দেখতে চায়। মনস্তত্ত্বটি সহজ—নেতারা এমন একটি সমাজের জন্য লড়ে যাবেন, যাতে সাধারণ মানুষ সুবিচার, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা, আশ্রয়, ভরসা, নির্ভরতা, নীতি-নৈতিকতা ও প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। দেশটির রাজনীতিতেও আছে চলচ্চিত্র শিল্প-সংশ্লিষ্টদের বিশাল অঙ্কের লগ্নি। চলচ্চিত্র এবং রাজনীতি—দুই যজ্ঞেই সফল মানুষের তালিকায় আছেন জয়ললিতা, রামা রাও, সুনীল দত্ত, হেমা মালিনী, অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্না, রাজেশ খান্না, রাজ বাব্বর, স্মৃতি ইরানি, জয়া বচ্চনসহ অনেকেই। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতিতে নায়ক-নায়িকাদের অংশগ্রহণ নতুন কিছু তো নয়ই, উল্লসিত-উচ্ছ্বসিত বা চমৎকৃত হওয়ার মতো কোনো বিষয়ও নয়। কিন্তু আমজনতার চোখে এরা এলিট। ওপরতলার মানুষ। খুব নিচুবর্গ থেকে উঠে আসা কেউ নন। অন্যদিকে রজনীকান্ত গরিবি, অল্পশিক্ষিতের সংগ্রামময় শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে আমজনতার নায়ক হয়েছেন। ‘আমাদের নিজেদের মানুষ’— এই গণচিন্তা-সম্পৃক্ততার সমীকরণই রজনীকে আম-মানুষের স্বপ্নের রাজনীতিকের বিশেষত্ব দিয়েছে।
হিরো আলম রজনীকান্ত নয়। এই লেখার উদ্দেশ্যও মোটেই তুলনামূলক আলোচনা নয়। কিন্তু আমজনতার ভাবনার বা গণমনস্তত্ত্বের একটি সুগভীর মিলের দিকে দৃষ্টি দেওয়াও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের দায় ও দায়িত্ব বলে হিরো আলম বিষয়-ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
হিরো আলম বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিস্মরণীয় বাঁক। কারণ, তাঁকে নিয়ে আলোচনা নির্বাচনের প্রথম দিন থেকেই। মিডিয়া তাঁকে নিয়ে মশকরা করতে নেমেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বাভাবিক এবং সপ্রতিভ। তাঁর যুক্তি ছিল ক্ষুরধার। কখন বলতে শুরু করে করে কখন থামতে হয়, হিরো আলমের সেই পরিমিতিজ্ঞানটিও টেলিভিশনের অনেক নিয়মিত টক শো আলোচকের চেয়ে ভালো দেখা গেল। বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। ‘ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও চা-বিক্রেতা ছিলেন, তাহলে আমি কেন পারব না।’ বিবেচনায় নেওয়ার মতো তাঁর কয়েকটি উক্তি ছিল —‘আমি স্বপ্ন দেখতে জানি’; ‘আমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার কাজ আমাকেই করতে হবে’; ‘আমি নিরন্ন অবস্থা থেকে উঠে এসেছি নিজের চেষ্টায়, কারও দয়ায় নয়’; ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়া আমার নাগরিক অধিকার’। আমজনতার চোখে হিরো আলমের আত্মমর্যাদা-সচেতনতা আবারও ধরা দেয় ইসি সচিবের পদত্যাগ দাবির মাধ্যমে। তাঁর ভাষাচয়ন ছিল যথাযথ, বক্তব্য স্পষ্ট। আরও উল্লেখ্য, তাঁর নিজেকে উপস্থাপন, শরীরী ভাষা, কিংবা আত্ম-বিশ্লেষণের ধরন কোনোটিই পেশাজীবী রাজনীতিকদের মতো মেকি ও কপট ছিল না।
হিরো আলম রজনীকান্তের উদাহরণ টানেননি সম্ভবত। যদি টানতেনও যে রজনীকান্তও তো নিচুতলা থেকে উঠে আসা আগামীর রাজনীতিক এবং ভারতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী—ভুল বলা হতো না মোটেও।
গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার ঠিক আগে আগে একজন বন্ধু যখন খানিকটা আক্ষেপ করে বললেন, ‘হিরো আলমের ছবি যে কবে পাঁচ শ’ টাকার নোটে দেখতে পাব’—চমকে উঠেছিলাম। চমৎকৃত হওয়ার কারণ হিরো আলম শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উন্নাসিকতার ট্যাবু ভেঙে দিয়ে তাদের ড্রয়িংরুমে উঠে এসেছেন। এই সময়ের রাজনীতির সবচেয়ে নজরকাড়া ও কৌতূহল জাগানো বাঁক এই যে হিরো আলম উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মহলেও যথেষ্ট আলোচনা ও সমাদর পাচ্ছেন। বন্ধুর উক্তিটির গভীরেও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি সাধারণ মধ্যবিত্তের তীব্র ঘৃণা, অসন্তোষ, অসমর্থন, অননুমোদন, হতাশা, বিরক্তি, ভীতি এবং অসহায়ত্বের প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মধ্যবিত্ত যা বলতে পারছে না হিরো আলম অকপটেই বলেছে। যেমন ‘আমার মতো সামান্য একজন মানুষকেও সরকার ভয় পায়’, কিংবা ‘ভোটই দিতে দেয়নি, জামানত ফেরত দেবে না কেন’ (চমৎকার নৈতিকতা-প্রসঙ্গ অবশ্যই)—তখন হিরো আলমের মধ্যে মুখচোরা ও সমঝোতাকামী ভীতু মধ্যবিত্তরাও সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন নিশ্চয়।
একজন ফেসবুকবন্ধু সামাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন—হিরো আলম কি বাস্তবের হিরো, নাকি আরোপিত। প্রশ্নটির উত্তরে লিখেছিলাম—‘হিরো আলম “মনস্তাত্ত্বিক” হিরো; সমাজতাত্ত্বিক, বাস্তবিক বা ফ্যান্টাসি জাগতিক কোনো হিরো মোটেই নয়।’ ধরা যাক, ছোট ছোট বাচ্চারা ঈদের নতুন জামাকাপড় পেয়েছে। সেগুলো পরে ফেলতে আর তর সইছে না। মুরব্বিরা বললেন, এবারের ঈদ ২৯ রোজা শেষে হবে। ২৯ রোজার সন্ধ্যায় তারা শতভাগ নিশ্চিত কাল ঈদ। তাই দলে দলে চাঁদ দেখতে নামল। চাঁদের কিন্তু দেখা নেই। তবু একটি শিশুর মনে হলো, চাঁদ দেখেছে সে। সোল্লাসে শিশুটি ‘ওই যে চাঁদ ওই যে চাঁদ’ চিৎকার দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য শিশুরাও আনন্দে হই হই উল্লাসে নামল। সবাই বলল, তারা চাঁদ দেখেছে (আসলে কেউই দেখেনি)। হিরো আলমও একই রকম আপাতপ্রত্যাশার, আপাতপ্রবোধের চাঁদ। না দেখেও ‘দেখেছি দেখেছি’ আনন্দটুকুর চাঁদ। (বাস্তবতা, চাঁদ দেখা যায়নি, ৩০ রোজা শেষেই ঈদ, শিশুদের আনন্দে ভাটা; মেনে নিতে হয় বলে তারাও মেনে নেয়)।
ফেসবুকের পোস্টটির প্রত্যুত্তরে পাওয়া একটি মন্তব্য—‘হিরোর তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টার প্রমাণ মিলল নোয়াখালীর সুবর্ণচরের গণধর্ষিতাকে দেখতে যাওয়ার মাধ্যমে।’ অনেকগুলো মন্তব্যের সারমর্ম—‘ডুবন্ত মানুষ যেমন কুটো ধরেও বাঁচতে চায়, বাংলাদেশের অপরাজনীতির বিভীষিকা থেকে বাঁচতে মানুষ হিরো আলমকেও অবলম্বন ভাবতে দ্বিধাবোধ করছে না। হিরো তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, আমরা একই রকম দায়িত্ব পালন করিনি বলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সুদূরপরাহত হয়ে গেল।’ হিরো আলমবিরোধী মন্তব্য একটিও নেই। মন্তব্যগুলো আমাদের গণমনস্তত্ত্বকে স্পষ্ট করছে। সুস্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে তৃণমূল থেকে আরও নতুন মুখ, নতুন হিরো আলমেরা উঠে এলেও আসুক, তবুও প্রচলিত রাজনীতি-কাঠামো ভেঙেচুরে শুদ্ধতামুখী এবং শান্তি ও ন্যায়বিচারমুখী একটি সমাজের আশা জেগে উঠুক গণমানুষের রাজনীতিচিন্তায় ও কর্মে।
সর্বান্তকরণে হিরো আলমের মঙ্গল চাই। কামনা করি, তিনি রাজনীতিতে টিকে থাকুন, জানুন, শিখুন, পড়াশোনা করুন, নিজেকে নির্মাণ করুন স্বপ্নপূরণের জন্য; অনুকরণীয় হয়ে উঠুন অন্যদের জন্য এবং একসময় রজনীকান্তের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠুন।
হেলাল মহিউদ্দীন: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।