বিদেশের খবর: ঐক্যের তাগিদটা বিরোধী শিবিরে বছরখানেক ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। হয়তো যৌথ রণকৌশল তৈরির প্রক্রিয়াটাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সম্মিলিত অ-বিজেপি শক্তির প্রথম বিস্ফোরণটা কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডেই ঘটল। সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র্যালি’। বিস্ফোরণটার অভিঘাত ভারতের পূর্ব প্রান্ত থেকে পৌঁছে গেল সুদূর পশ্চিমে। সিলভাসার জনসভা থেকে নরেন্দ্র মোদীর কটাক্ষ— রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি, তাই ওঁরা মহাগঠবন্ধনে।
ব্রিগেডে ভিড়ের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যেতে হবে— দলীয় স্তরে এমন অলিখিত নির্দেশ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে ছিলই। মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে ভারতের জাতীয় রাজনীতির প্রায় গোটা বিরোধী শিবির যে ভাবে ব্রিগেডের মঞ্চে হাজির হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাতে তাক লাগানোর মতো জমায়েত করার তাগিদ আরও বেড়ে গিয়েছিল তৃণমূলের। তাই মহানগরের নানা প্রান্ত হোক বা শহরতলি, জেলা শহর হোক বা প্রত্যন্ত গ্রাম— সব এলাকা থেকে যত বেশি সম্ভব লোকজনকে নিঃশেষে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে ব্রিগেডে হাজির করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৃণমূল নেতৃত্ব।
জমায়েত ঠিক কত লক্ষের হল, তা নিয়ে পুলিশের নানা সূত্রের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আসা রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের অধিকাংশই এ দিন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ব্রিগেডের জমায়েতটা দেখে।
গুজরাত থেকে এসেছিলেন পাটিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক পটেল। ভাষণের শুরুতেই ‘জনসৈলাব’ (জনতার ঢল) নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন তিনি। উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা তরুণ আরএলডি নেতা জয়ন্ত সিংহ বললেন, ‘‘আমরা জানতাম র্যালি হবে। কিন্তু এসে যা দেখছি, তাকে আমাদের উত্তর ভারতে র্যালা (সুবিশাল র্যালি) বলা হয়।’’ আর উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সপা সুপ্রিমো অখিলেশ যাদব বললেন, ‘‘যত দূর চোখ যায়, শুধু মাথা আর মাথা দেখছি।’’
এতেই অবশ্য শেষ নয়, ‘মরাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পওয়ার থেকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল, লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব থেকে ‘বিহারি বাবু’ তথা বিজেপি সাংসদ শত্রুঘ্ন সিন্হা— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা সমাবেশের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একের পর এক নেতা।
ভিড়ের আকার ব্রিগেডের এই সমাবেশকে নতুন মাইলফলকে পৌঁছে দিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু যে রাজনৈতিক রামধনুটা এ দিন ব্রিগেডের মঞ্চে তৈরি হল, তা অবশ্যই ঐতিহাসিক, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জম্মু-কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে অরুণাচল প্রদেশ— দেশের কোন প্রান্ত এ দিন হাজির হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে, তা খুঁজে বার করা কঠিন।
শুধু এক মঞ্চে হাজির হওয়াই কিন্তু নয়, ঐক্যের বার্তাও এ দিন খুব স্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছে ব্রিগেড সমাবেশ। ঐক্যের প্রচেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছিল, সে কথা ঠিক। কখনও অখিলেশ বা কেজরীবালের ডাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সভা করতে যাচ্ছিলেন লখনউ বা দিল্লিতে, কখনও উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে বিজেপি বিরোধী দলগুলো হাত মিলিয়ে লড়াই করে ধরাশায়ী করছিল বিজেপি-কে, কখনও সনিয়া গাধীর ডাকে সমন্বয় বৈঠকে বসছিল দেশের প্রায় সব বিজেপি বিরোধী শক্তি, কখনও চন্দ্রবাবু নায়ডুর উদ্যোগে বৈঠক হচ্ছিল মোদী বিরোধী রণকৌশল নির্মাণের জন্য। কিন্তু এত কিছুর পরেও বিরোধী ঐক্যের রূপরেখাটা খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসছিল না, বিজেপি বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতার চেহারাটা ঠিক কেমন হবে, তা স্বচ্ছ ভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতায় যে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া র্যালি’ শনিবার হল, সেই র্যালি কিন্তু বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতাসূত্রের বার্তা খুব স্পষ্ট ভাবেই উপস্থাপিত করল বিপুল জনতার সামনে।
ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লার বার্তা, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা পরে স্থির করা যাবে, আগে নির্বাচনটা একসঙ্গে লড়া দরকার। লোকসভায় কংগ্রেসের যিনি দলনেতা, সেই মল্লিকার্জুন খড়্গের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘মন মিলুক, না মিলুক, হাত মেলা জরুরি।’’ আর এক কংগ্রেস নেতা তথা বাংলা থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত সাংসদ অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এ দিনের মঞ্চকে তুলনা করলেন রামধনুর সঙ্গে, বিজেপি-কে হারাতে হলে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিলেন। আর দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা জেডিএস নেতা দেবেগৌড়া আরও স্পষ্ট বার্তা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কারও একার পক্ষে বিজেপি-কে হারানো কঠিন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত মোর্চা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করা দেবেগৌড়ার বার্তা— জোট সরকারের কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে এবং জোট সরকার কর্মক্ষম হয় না, এমন ভাবনা দূর করতে হবে।
সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সবচেয়ে সুসংহত জোটবার্তাটা অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই দিলেন এ দিন। বিজেপির নিরন্তর কটাক্ষের জবাবটাও অত্যন্ত স্পষ্ট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়ে দিলেন। বিরোধীরা জোট তো গড়ছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে? এই প্রশ্নই শ্লেষাত্মক ভাবে বার বার তুলছিল বিজেপি। সবাইকে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। ভোটের পরে আমরা ঠিক করে নেব প্রধানমন্ত্রী কে হবে।’’ বিজেপি বিরোধী জোটে এতজন অভিজ্ঞ নেতা রয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না? পাল্টা প্রশ্ন তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজেপির নিরন্তর কটাক্ষের যে জবাব তৃণমূল চেয়ারপার্সন এ দিন দিয়েছেন, সেই জবাবটা যে বিরোধী শিবিরের কাছে এত দিন ছিল না, তা নয়। বিক্ষিপ্ত ভাবে বা অগোছালো ভাবে এই কথাটাই বার বার সামনে আসছিল এত দিনও। কিন্তু দেশের প্রায় সবক’টা উল্লেখযোগ্য বিজেপি বিরোধী শক্তি একমঞ্চে হাজির হয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাবে এবং সমস্বরে বলছে যে, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা ভোটের আগে নির্ধারণ করার প্রয়োজনই নেই, ভোটের পরেই প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে কোনও সমস্যা হবে না, আপাতত ঐক্যবদ্ধ থাকাই একমাত্র লক্ষ্য— এই দৃশ্যপট প্রথম বারের জন্য তৈরি হতে পারল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই।
বিরোধী ঐক্যের এই ছবি যে নরেন্দ্র মোদীকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে, সেটা তার প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট। সিলভাসায় তিনি বলেন, ‘‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার অভিযান কয়েক জনকে রাগিয়ে দিয়েছে। খুবই স্বাভাবিক। ওঁরা মানুষের টাকা লুঠ করছিলেন। আমি সেটা রুখেছি। তারই পরিণতিতে ওঁরা জোট বেঁধেছেন। মহাজোট। বিজেপির বিরোধিতা করছেন। আদতে তাঁরা দেশেরই ক্ষতি করছেন।’’ আনন্দবাজার অবলম্বনে।