বিদেশের খবর: নির্বাচনের আগে আগে রাজিব তনয়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে হাজির হয়েছে কংগ্রেস। যাকে ভারতের রাজনীতিতে এক শক্তিশালী ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বিবেচনা করছে দলটি। এরই মধ্যে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন প্রিয়াঙ্কা। আর তাতেই ঢাকা পড়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির ম্যাজিক।
কংগ্রেস যেখানে মে মাসের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে একের পর এক নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে, সেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার ক্ষমতাসীন দল বিজেপি চলছে গতানুগতিক কৌশলেই। ফলে ভারতজুড়ে কংগ্রেসের সরব আলোচনার স্রোতে যেন কিছুটা ঢাকাই পড়ে যাচ্ছে মোদির রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
৪৭ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কা মে মাসের জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে পূর্ব উত্তরপ্রদেশে দলের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকবেন। তার দায়িত্বে থাকা এই এলাকার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্বাচনী এলাকাও রয়েছে।
তাই কংগ্রেসের এই নতুন রাজনৈতিক আলোড়নের দুলুনি মোদির গায়ে কমবেশি লাগবেই।
কংগ্রেসের এই ‘বংশপরম্পরামূলক’ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ইন্ডিয়া টাইমস জানিয়েছে, গত বুধবার মহারাষ্ট্রের পাঁচটি অঞ্চলের বিজেপি বুথকর্মীদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিজেপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়, যেখানে অন্য অনেক ক্ষেত্রেই একেকটা দল চালায় কোনো পরিবার।
কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়ে মোদি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে একটা পরিবারই রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। সেখানে বিজেপি দলটাই একটা পরিবার। এখানে দলের কর্মীদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্যক্তি বা পরিবারের ইচ্ছায় কাউকে উচ্চ পদে বসিয়ে দেয়া হয় না।
এমনকি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে শক্তিশালী অন্তর্ভুক্তি হিসেবে না দেখে তাকে ‘চকলেট’ বা সমর্থক দর্শনধারী একজন ব্যক্তিত্ব বলেও তিরস্কার করেছেন বিজেপির আরেক নেতা।
কিন্তু বিজেপি প্রধানের আক্রমণাত্মক কথায় কংগ্রেস আলোচনা থেকে সরছে না মোটেও। বরং উল্টো বিজেপির দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে অন্য দলগুলো।
আম আদমি পার্টির অন্যতম নেতা এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল শুক্রবার অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার রাজনৈতিক লড়াই লড়ছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে। তিনি বলেন, মোদি আর বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ সমাজবাদী পার্টি প্রধান অখিলেশ যাদব, বিএনপি প্রধান মায়াবতী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, এমনকি তার দলেরও একজন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকেও হয়রানি থেকে ছাড় দেননি। গত সপ্তাহে সিনিয়র কংগ্রেস নেতা ও হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুদার বাসায় সিবিআইয়ের অভিযানের প্রতিবাদে মমতার কথায় সুর মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘অখিলেশ যাদব থেকে শুরু করে বোন মায়াবতী, কেউই রেহাই পেলেন না। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম – সবখানেই বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিশোধ। তারা কি ভীত? তারা কি এতটাই মরিয়া?’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির যেন পুরো দেশেই একজোট হচ্ছে বাকি দলগুলো। কেজরিওয়ালের এমন বক্তব্য, পূর্ব উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রের আসা, সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াংকার আগমনকে অখিলেশ-মায়াবতী জোটের স্বাগত জানানো, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজেপি বাদে বাকি সব দলকে এক করা, এমনকি মোদির র্যালি সেখানে ঢোকার অনুমতি পর্যন্ত না দেয়া; যে কারণে র্যালির তারিখ পেছাতে বাধ্য হলেন মোদি… সবকিছু এমনটাই ইঙ্গিত করে।
মে মাসের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে একসাথে লড়াইয়ে নামতে রাজি হয়েছে সমাজবাদী দল ও বহুজন সমাজ পার্টি। ২০ কোটির বেশি মানুষের বাস এই রাজ্যে। শুধু তাই নয়, আঞ্চলিক আরও কিছু দলকে জোটে নেয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে বলেও রোববার এক সাক্ষাতকারে বলেছেন সমাজবাদী দলের মুখপাত্র রাজেন্দ্র চৌধুরী।
হিন্দু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করে আসা বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলিতসহ অন্য অনগ্রসর শ্রেণি ও সংখ্যালঘুদের ভোট নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টায় আছে অখিলেশ যাদব-মায়াবতী জোট। অন্যদিকে কুম্ভস্নান, রোড-শো, জনসভা, বহু বছরের বিরোধ ভুলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে সব বর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বীরই সমর্থন কুড়োচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা-রাহুল।
নিম্নবর্ণের ভোট যাদব-মায়ারা দখলের পর যদি এখন কংগ্রেস উচ্চবর্ণের ভোটও নিয়ে যায়, তাহলে বিজেপির রইল কী?
এজন্যই জাত-বর্ণ ভুলে সব হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারকে ‘হিন্দু ছাতা’র তলে আসার বার্তা দিয়েছেন মোদি। এমনকি চলতি মেয়াদের সর্বশেষ বাজেটে জনগণের ওপর চাপ পড়ে, এমন সংস্কারের বিষয়গুলো অন্তত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাখতে চাইছেন না তিনি। বরং চেষ্টা করছেন এমন কিছু নীতি-পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে যাতে জনগণের সমর্থন আদায়ে সুবিধা হয়।
কিন্তু এখানেও সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা তাকে সাবধান করে দিয়েছেন, শুধু নির্বাচনের কথা ভেবে হুট করে এ ধরনের পরিকল্পনার ফলে বাজেটের ঘাটতি আরও অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। ফলে আখেরে ক্ষতি সরকার-জনগণ দু’পক্ষেরই হবে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক আরেকটি জটিলতা তো থাকছেই। এই মোদি সরকারের আমলেই ভারতের ব্যাংকঋণের হার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
জরিপ কী বলে নির্বাচনকে সামনে রেখে আপাতত নিজ সরকারের অর্জন আর অন্যান্য দলগুলোর সমালোচনা ছাড়া নতুন তেমন কোনো কায়দা দেখাতে পারছে না ক্ষমতাসীন বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে দলের অন্যান্য নেতাদেরও কমবেশি একই অবস্থা।
অন্যদিকে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো একে অপরকে সমর্থন করে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে চলছে। সে তুলনায় বলা চলে নির্বাচনের আগে মোদির রাজনীতিতে একরকম খরাই চলছে।
এতকিছুর পরও সাম্প্রতিক কিছু নির্বাচনপূর্ব জরিপে দেখা গেছে, সার্বিকভাবে এখনো অধিকাংশ মানুষ নরেন্দ্র মোদিকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরেক মেয়াদে চায়। ফার্স্টপোস্ট-ইপসস পরিচালিত ‘ন্যাশনাল ট্রাস্ট সার্ভে’ জরিপে মোদি পেয়েছেন ৫৩ শতাংশ সমর্থন। আর রাহুল গান্ধী পেয়েছেন মাত্র ২৬.৯ শতাংশ।
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে মোদির সমর্থক বেশি। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা ও তামিলনাড়ুর মতো শক্তিশালী রাজ্যগুলোতে রাহুল অনেক বেশি ব্যবধানে জরিপে জয়ের সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। এর কাছাকাছি রাজ্যগুলোতে মোদি-রাহুল সমর্থন হাড্ডাহাড্ডি পর্যায়ের।
এই দূরত্ব দূর করে জনগণের সমর্থন আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে কংগ্রেস। গত জুলাইয়ে রাহুল বলেছিলেন, বিজেপি’কে হারাতে প্রয়োজনে নির্বাচনে মায়াবতী আর মমতাকে সমর্থন দেবে তার দল।
এই মরিয়া চেষ্টার ফল হিসেবে ডিসেম্বরের বিধানসভা নির্বাচনে ৫ রাজ্যের ৩টিতেই জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। এই জয়ের পর পরিচালিত এক জরিপে ধারণা করা হলো, আসন্ন কেন্দ্রীয় নির্বাচনে বিজেপি জোট মাত্র ২৫৭টি আসন পেতে পারে। ৫৪৩ আসনের নিম্নকক্ষের অর্ধেক থেকে এই সংখ্যাটা ১৫ আসন কম। যদিও ভারতে পরিচালিত জরিপ সবসময় খুব একটা সঠিক হয় না।
টাইমস অব ইন্ডিয়া এর আগে প্রকাশিত রিপোর্টে জানিয়েছিল, উত্তর প্রদেশে দুই দল কংগ্রেসকে বাদ দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে আসন বণ্টনের ঘোষণা দিতে পারে। দুই দলের প্রত্যেকে ৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিতে পারে। উল্লেখ্য, এই রাজ্যটিতে সাধারণ নির্বাচনের আসন রয়েছে ৮০টি।
বিজেপির বিরুদ্ধে আরও বড় জোট গড়ার জন্য বাকি কিছু আসন অন্যান্য দলের জন্য রাখা হবে। পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশে জেতাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদির দল এখান থেকে ৭১টি আসনে জিতেছিল।
কিন্তু বর্তমানে মোদির নানা প্রকল্প তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। রাহুলের জনপ্রিয়তা একদিকে ধীরে ধীরে বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে মোদির জনপ্রিয়তা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দূষণমুক্ত করে গঙ্গা সংরক্ষণ করতে নিজের ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প নিয়ে অনেক হাঁকডাক দিলেও বাস্তবে মোদি সরকারের আমলে গঙ্গায় দূষণ আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।
গত লোকসভা নির্বাচনে বারানসিতে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, তিনি মা গঙ্গার ডাকে এসেছেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরীক্ষায় গঙ্গায় সব থেকে বেশি দূষণের মাত্রা মিলেছে মোদির সেই লোকসভা কেন্দ্র বারানসিতেই।
২০১৮-র জুনে এই রিপোর্ট তৈরি হলেও এত দিন তা ধামাচাপা ছিল। এ বার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা প্রকাশ হয়েছে। এখন সেই নমামি গঙ্গে প্রকল্পে আরও বরাদ্দ দিতে আবার নিজের পাওয়া উপহারগুলো নিলাম করছেন প্রধানমন্ত্রী। এটা জনগণের ভরসায় আরেকটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন যোগ করতেই পারে।
আরও একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি হলো তুমুল বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নির্যাতনের শিকার অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিতে বিল পাস। ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গত ৮ জানুয়ারি পাস হওয়া বিলটি অনুসারে, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ভারতে থাকার আবেদন করলেই মিলবে নাগরিকত্ব।
কংগ্রেসসহ বামপন্থি দলগুলো বলছে, কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষদের নাগরিকত্ব দেয়ার এমন আইন ভারতের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ‘নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল, ২০১৯’ প্রস্তাব করার সাথে সাথেই জ্যেষ্ঠ কংগ্রেস নেতা মল্লিক অর্জুন খার্গে বিরোধিতা করে বলেন, বিলটিতে এমন কিছু ‘ভুল’ আছে যেগুলো আসাম চুক্তির বিরুদ্ধে যায়।
এই বিলের ফলে আসাম অঞ্চলে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে।
ইন্ডিয়াটুডের নির্বাচনপূর্ব জনপ্রিয়তার মতামত জরিপেও দেখেছে, এখনো সার্বিকভাবে মোদির অবস্থান ওপরে থাকলেও জনপ্রিয়তার সূচকে ধীরে ধীরে রাহুলের অবস্থান ওপরের দিকে উঠছে। আর মোদি নামছেন নিচের দিকে।
নির্বাচন আসতে আসতে কংগ্রেসের নানা চমক আর ‘জোট-সমর্থনের’ ঢেউয়ের তোড়ে বিজেপির অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।