দেশের খবর: ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ননক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন মো. ইব্রাহিম। পরিবার দরিদ্র হলেও তাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ, ইব্রাহিম চলাচল করতেন ৩৬ লাখ টাকার দামি গাড়িতে। শুধু তাই নয়, খুলনা নগরীর মুজগুন্নীতে ৬ শতাংশ জমিতে চার তলার ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। নড়াইলে ডুপ্লেক্স বাড়ি। এর সবই হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে করা অবৈধ আয়ে।
গত দেড় বছরে প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় মোট ৪৬ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই ইব্রাহিম।
সিআইডি বলছে, সরকারি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি এমনকি বিসিএস পরীক্ষাতেও প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতি হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। পরীক্ষায় জালিয়াতি ও প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ৩০ কোটির বেশি টাকার সম্পত্তি হাতিয়েছেন মো. ইব্রাহিমসহ ৬ মাস্টারমাইন্ড।
সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায় দুই উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস হত। পরীক্ষার আগের রাতে প্রেস থেকে। আরেকটি হলো- ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে।
ডিজিটাল চক্রটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করত। সঙ্গে সঙ্গেই ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করে আসছিল।
তদন্তের পর বিভিন্ন সময় অভিযানে ডিজিটাল জালিয়াত চক্রটির মাস্টারমাইন্ড বিকেএসপির (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, মূল হোতা ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ইব্রাহিম মোল্যা, বিএডিসি’র সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, আইয়ুব আলী বাঁধনসহ মোট নয় সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম। চক্রটি গত কয়েক বছর ধরে লাখো তরুণের স্বপ্নের চাকরি বিসিএস পরীক্ষাতেও জালিয়াতি করেছে বলে জানা যায়।
পরবর্তিতে জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হাফিজুর রহমান হাফিজ ও ব্যবসায়ী মাসুদ রহমান তাজুলকে গত সপ্তাহে গ্রেফতার করে সিআইডি।
অলিপ, ইব্রাহিম, মোস্তফা, তাজুল, হাফিজ ও বাঁধন- ডিভাইজ জালিয়াতির এই ছয় মূল হোতার প্রত্যেকের আবার নিজস্ব সহযোগী চক্র ছিল। সর্বশেষ অভিযানে তাদের সহযোগিদের কয়েক জনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
মুম্বাই থেকে আনা হয় প্রশ্নফাঁসের ডিজিটাল ডিভাইস
ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসে ও জালিয়াতিতে পারদর্শী ছিলেন অসীম বিশ্বাস। অসীম ছিলেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নফাঁসকারী মাস্টারমাইন্ডদের অন্যতম তাজুলের সহযোগী। পরীক্ষায় জালিয়াতিতে ব্যবহৃত কয়েক শত ইলেকট্রনিকস ডিভাইস আমদানি করেছিলেন ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অসীম বিশ্বাস। আর এর সবই তিনি আমদানি করেন মুম্বাই থেকে।
ইব্রাহিম মোল্যার বিলাসী জীবন
দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইব্রাহিম জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে দাবি সিআইডির! ৩৬ লাখ টাকার দামি গাড়িতে তার চলাচল। জালিয়াতির টাকায় খুলনা নগরীর মুজগুন্নী এলাকায় সাড়ে ছয় শতাংশ জমির ওপর চারতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। নড়াইলে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এ ছাড়া অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করতেন তিনি। ইব্রাহিম অল্প দিনেই চাকরি ছাড়াই গোপালগঞ্জ সদরে ধনী বনে যান।
ব্যাংকার হাফিজের অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকার লেনদেন
হাফিজুর রহমান হাফিজের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের জামাদারপড়ায়। জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে তিনি চাকরি করলেও আড়ালে ছিলেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতচক্রের তৃতীয় অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। হাফিজের ব্যাংকে প্রায় ১০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল ডিভাইস চক্রের ৬ মাস্টারমাইন্ডের অঢেল অর্থ-সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা প্রশ্ন ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি করে আয় করেছেন। অলিপ কুমার বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতির মাস্টারমাইন্ড। কয়েক বছরে জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি দুই কোটি টাকা আয় করেছেন। ইব্রাহিম, হাফিজ, মোস্তফা, তাজুল ও বাঁধন বিসিএসসহ সব নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মূল হোতা।
তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের মধ্যে আছে ছাত্র, শিক্ষক ও বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা। এই অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছিলেন বিশাল বিত্ত-বৈভব। তাদের অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার লক্ষে তাদের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় গত ৭ জানুয়ারি মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫) মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই মামলায় গ্রেফতার ৪৬জনসহ শতাধিক আসামি করা হয়েছে।
আমরা নেমেছিলাম পুরো চক্রটিকে ধরব বলে। আমরা সফল হয়েছি। এই চক্রটি গ্রেফতারের মাধ্যমে একটি শক্ত ম্যাসেজ দেয়া গেছে। যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ প্রশ্নফাঁসের ধৃষ্টতা না দেখায়।