খোলা মত

গর্ব কিসে চা-সিঙ্গারায় নাকি মান-মর্যাদায়?

By Daily Satkhira

February 01, 2019

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়– যে নামটি উচ্চারণের সাথে সাথেই চেহারার মাঝে আসে পরিবর্তন, গ্রহণযোগ্যতার জায়গাটি পালটে যায়। ভাবনার জগতে শুরু হয়ে যায় পর্যালোচনা আর ফিরে যাই ইতিহাসের পাতায়। এই বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখান রচিত হয়েছিলো আমাদের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে এর নাম।

পাঠক হয়তো ভাবছেন সেতো ইতিহাসের কথা। জানি অনেকেই মুচকি হাসছেন আমার এ লেখা পড়ে। হাসতেই পারেন কারণ কিছুটা হলেও হাসি উৎপাদনের স্থানেতো গিয়েছেই। এই মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত বিষয় হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের করা একটি মন্তব্য। চলছে পত্র পত্রিকায় নানা ব্যঙাত্মক আলোচনা, কার্টুন। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই ব্যাঙাত্মক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।

কেউ কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোকে বিকৃত করে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। এসবের পিছনে একটাই কারণ আর তা হচ্ছে উপাচার্য মহোদয়ের করা একটি বক্তব্য। তিনি কী বলেছেন? বলেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও ১০ টাকায় সিঙ্গারা, সামুচা, চা পাওয়া যায়। হয়তো কথাটি তিনি ঠিকই বলেছেন বা তথ্যগত ভুল থাকতে পারে। তিনি আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। ভাষায় এখনও তিনি শহুরে হতে পারেন নি এটা তাঁর দোষ বলা যাবে না। তিনি চেষ্টাই করেননি বা করলেও পারেন নি বা এটাকে প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন নি।

যদিও একজন উপাচার্যের ভাষা বা উচ্চারণের যথার্থতা আমরা কামনা করতেই পারি কিন্তু কেউ যদি আঞ্চলিক উচ্চারণে কোন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন আবার আরেকজন যদি অতি শুদ্ধ উচ্চারণে অতি নিম্নমানের কোন বক্তব্য দেন তবে কোনটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত? ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনাটাই জরুরি। তাই আমাদেরকে মনোযোগ দিতে হবে আসলে বক্তব্যের বিষয় বস্তু ও উপস্থাপনের দিকে।

উপাচার্য মহোদয় আসলে কোন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেননি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের গর্বের জায়গা হওয়া উচিত তাঁর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার মান কতটা উচ্চে কতটা বিশ্বমানের সেটি নিয়ে, গর্ব করতে পারেন কয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলোর সামাজিক অবদান কতটা সেই নিয়ে, গর্বিত হওয়া উচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্ররা কে কোথায় আছে সেটি নিয়ে, বিশ্বের কোন কোন ক্ষেত্রে কারা কী ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে সেগুলো নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে উচ্চশিক্ষাকে সকলের জন্য সহজলভ্য করে দেশ ও জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা। এখানে খাদ্য থেকে শুরু করে প্রতিটা বিষয় হওয়া উচিত গুণগত মানসম্পন্ন। অথচ কে না জানে, হলগুলোতে খাবারের মান কতটা নিম্ন, কতটা হতাশাজনক।

কোন ছাত্রই উপাচার্যের কাছে এখানে কত সুলভে খাবার পাওয়া যাবে সে নিশ্চয়তা চায় না বা চাইতে আসে না। তাদের এবং তাদের অভিভাবকদের একটাই প্রত্যাশা থাকে আর সেটা হচ্ছে কতটা ভালোমানের শিক্ষা তারা নিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে একজন প্রকৃত ও আদর্শ মানুষের জায়গায় নিয়ে যাবার মত জীবনমুখী শিক্ষা তারা পাচ্ছে এখানে। যে যেভাবে জীবনকে জানতে বা গড়তে চায় সেখানে কতটা সাহায্য পাচ্ছে সে বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায় চাওয়ার তালিকায়।

অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন প্রায় একটি ফসিলের জায়গায় চলে যাওয়ার অবস্থায় আছে। বিশ্ব র‌্যাংকিং এর হিসাব বাদ দিলেও আভ্যন্তরীণ র‌্যাংকিংয়েও প্রথম দিকে থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। যদিও র‌্যাংকিং দিয়েও যে মান সঠিক নির্ধারণ করা যায় তা না তবে র‌্যাংকিং অন্তত একটি ইনসাইট দেয়। প্রেরণার জায়গায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বের হচ্ছে অথচ তাদের বেশিরভাগেরই মানোন্নয়ন থেকে যায় প্রশ্নবিদ্ধ। না তারা সামাজিকভাবে শিক্ষিত হতে পারছে না রাজনৈতিক। একটা সময়ে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগুলো সব তৈরি হতো এখান থেকে। শিক্ষকদের মাঝেও তাই ছিলো প্রতিযোগিতা কে কতটা ভালো শিক্ষক হতে পারবে। আর এখন? হতাশাই হতাশা। নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে হাজার অভিযোগ। ছাত্র ভর্তিপ্রক্রিয়া হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুইদিন পরপর আন্দোলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি রাষ্ট্রের অনেক সম্মানিত ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি পদ। দেশের আর দশটা উপাচার্যের চেয়ে এই প্রতিষ্ঠানের উপাচার্যের মর্যাদা তাই সবজায়গাতেই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। অথচ আমরা দেখছি একের পর এক সমালোচনার জালে জড়িয়ে পড়ছেন আমাদের বিগত ও বর্তমান উপাচার্যরা।

কেন এমন হচ্ছে? কেন তাঁরা ব্যর্থ হচ্ছেন একটি রাষ্ট্রীয় পদের মর্যাদা রাখতে? উপাচার্য নির্বাচন হয়ে পড়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর কোনটাই জাতির জন্য সুখবর নিয়ে আসছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এই বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা বাদ দিলেও সমাজে একটি আদর্শিক অবস্থানকে নিশ্চিত করতে এই বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষক ছাত্রদের রয়েছে বিশাল অবদান ও কাজ করার সুযোগ।

এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি। একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসাবে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাই দয়া করে এই প্রতিষ্ঠানটিকে একজন যোগ্য ও সঠিক প্রশাসনের হাতে দিন যিনি কাজ করবেন দুর্নীতি ও দুর্বল সিস্টেমের বিরুদ্ধে। আমার মত লাখো শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধানতম শিক্ষার জায়গা হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

জীবনের যা কিছু অর্জন তার পুরোটাই এসেছে এখান থেকে কারণ পরিবার কেবল গাইড করেছে আর এখানে শিখেছি জীবনের গান কেমন করে গাইতে হয় সেই সুর। কেমন করে দেশ ও সমাজকে জানতে হয়, কেন জানতে হয় এবং সেই জানাকে কেমন করে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে নিজেকে ও দেশকে পালটে দিতে কাজ করতে হয় সেই পথের সন্ধান দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র যার জন্য তিনি গর্ব করে থাকেন সবসময়। তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষার প্রধান ভূমিকাটি রেখেছে এই জায়গা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম যদি ধুলায় মিশে যায় তবে এর ফল ভোগ করতে হবে গোটা জাতিকে।

সামনেই ডাকসু নির্বাচন। রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্বকে দূর করতে একটি আশার স্রোত আমরা দেখতে পাচ্ছি। আশা করছি এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো প্রাণ ফিরে পাবে আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাস। ছাত্ররা জানতে শিখবে দেশ ও জাতির অনেক কিছু। যুক্ত থেকে লড়াই করতে শিখবে আবার।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি আশা করি এরপর একজন প্রশাসক খুঁজে বের করবেন যিনি ১০ টাকার বিনিময়ে খাবার দিয়ে গিনেস রেকর্ডে নাম উঠাতে চাইবেন না বরং গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিতি বাড়াবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ছাপ যেনো কিছুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আসে। সেই আশাতেই রইলাম।

লেখক : কলামিস্ট।