দেশের খবর: স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতুর অনৈতিক সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রামের তরুণ চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দুই আসামী স্ত্রীর বন্ধু মাহবুবুল হক ও ভারতীয় নাগরিক উত্তম প্যাটেলের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান করছে গোয়েন্দারা।
আকাশের আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচণার অভিযোগে গ্রেফতার স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে সোমবার। চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত শুনানির এই দিন ধার্য্য করেছেন। মিতুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিন হেফাজতে নিতে শনিবার আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এসআই আবদুল কাদের।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর নন্দনকাননে খালাতো ভাইয়ের বাসা থেকে মিতুকে গ্রেফতার করে সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
এদিকে ডা. আকাশের আত্মহত্যার প্ররোচনায় স্ত্রী তানজিলা হক চৌধুরী মিতুর দুই বয়ফ্রেন্ড প্যাটেল ও মাহবুবের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের গোয়েন্দারা।
তানজিলা হক মিতুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আমানত শাহ মাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করা মোবাইল ফোনটি এখন গোয়েন্দাদের হাতে। ওই মোবাইল থেকে বেশ কিছু তথ্যও উদ্ধার করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ডা. আকাশ আত্মহত্যা করার আগের দিন মধ্যরাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা একটি নম্বরে প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলেছেন মিতু। ধারণা করা হচ্ছে, নম্বরটি তার বয়ফ্রেন্ড উত্তম প্যাটেলের এবং ফোনে তাদের এই দীর্ঘ আলাপনকে কেন্দ্র করেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সেই রাতে কলহ বেঁধেছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতীয় এই নাগরিকের বাড়ি গুজরাটে। সম্প্রতি পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় গেলে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন তানজিলা হক মিতু। ম্যাসেঞ্জারে মিতুর সঙ্গে প্যাটেলের অশালীন ও নোংরা বাক্য বিনিময়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে সেই মোবাইল থেকেই।
তদন্ত সূত্র আরও জানায়, কল লিস্ট তল্লাশি করে মিতুর তার আরেক বয়ফ্রেন্ড ডা. মাহবুবুল আলমের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে আলাপচারিতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। খুব সম্ভবত ডা. মাহবুবের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। আবার এটাও হতে পারে যে, সাবধানতাবশত ফোনে কথা বলা এড়িয়ে মিতু ও মাহবুব অন্যকোনো উপায়ে যোগাযোগ রাখতেন। সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে তদন্ত কর্মকর্তারা।
ডা. আকাশের জব্দ করা ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থেকে গোয়েন্দার খুব বেশি তথ্য পাননি। আকাশ ঘন ঘন তার স্ত্রীকে ফোন করতেন, এটা জানা গেছে। সেই তুলনায় আকাশকে মিতু কল করতেন খুব কমই। এমনকি ঝগড়াঝাটি করে বাড়ি থেকে মিতু বেরিয়ে যাওয়ার পর আত্মহত্যার আনুমানিক আধাঘণ্টা আগেও দুইবার স্ত্রীকে কল দেন ডা. আকাশ। মিতু মোবাইলের মিসকল দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি কল রিসিভ করেননি। ওইসময় কল রিসিভ করলে হয়তো ভ্রান্ত আবেগে পুড়ে আত্মহননের সিদ্ধান্ত থেকে ডা. আকাশ সরে আসতেও পারতেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিতু উগ্র জীবনযাপনসহ নানা বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। এ সব তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।’
তানজিলা হক মিতু কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার আনিসুল হকের মেয়ে। মায়ের নাম সেলিনা শামীম। ছেলেমেয়েকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন মিতুর মা। বাবা থাকেন চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায়। ২০১৬ সালে ডা. তানজিলা হক চৌধুরী মিতুর সঙ্গে বিয়ে হয় ডা. মোস্তফা মোরশেদ আকাশের। এর আগে সাত বছর প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাদের। আত্মহত্যার আগে নিজের ফেসবুক আইডির টাইমলাইনে মিতুর লাগামহীন জীবন সম্পর্কে লিখেছেন ডা. আকাশ। এমনকি বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে ডা. মিতুর একান্ত মুহূর্তের কিছু ছবিও পোস্ট করেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি আকাশের আবেগঘন স্ট্যাটাস এখন কাঁদাচ্ছে তার পরিবার, স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য মানুষকে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তখন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ২০০৯-২০১০ সেশনের ছাত্রী তানজিলা চৌধুরী মিতু। ইন্টার্নশিপ করতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে পরিচয় হয় আকাশের সঙ্গে। তারপর গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। ওই সময়ই একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন মিতু। বিয়ের পরও বিভিন্নজনের সাথে সেই সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। এমনকি পড়াশোনার জন্য বিদেশে অবস্থানকালেও একাধিক ব্যক্তির সাথে বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মিতু।
এমনকি শুধু মিতু নন, তার পরিবারের বিরুদ্ধেও উঠছে নানান অভিযোগ। মিতুর উগ্র জীবনযাপনে সমর্থন, আকাশকে মানসিক নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে মিতুর পরিবারের বিরুদ্ধে। আকাশের ছোট ভাইয়ের বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ করেন, আকাশের আত্মহত্যার জন্য যতকুটু মিতু দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী তার পরিবার। তাদের আমানুষিক নির্যাতনের কারণেই আকাশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, মিতুর ছোট ভাই আরমান লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর নিজেদের আর্থিক অবস্থা গোপন করে ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। মিতুদের আর্থিক অবস্থা না জেনে ওই সময় তিনিসহ কয়েকজন টাকা উত্তোলনের নেতৃত্ব দেন। দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা এ টাকা উত্তোলন করে। কিন্তু আরমানের চিকিৎসার অর্ধেক টাকায় চিকিৎসা ব্যয় না করে নিজেরাই আত্মসাত করেন।
পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিজানুর রহমান জানান, বছর তিনেক আগে প্রেম করে বিয়ে করেন ডা. মোস্তফা মোরশেদ আকাশ ও তানজিলা হক চৌধুরী মিতু। বিয়ের পরপরই মিতু তার মায়ের কাছে আমেরিকায় চলে যান। তখন থেকেই বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ চলছিল। গত ১৩ই জানুয়ারি মিতু দেশে আসার পর এ নিয়ে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। বুধবার রাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। হাতাহাতিও হয় একপর্যায়ে। এরপর ফোনে খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে এসে মিতুকে নিয়ে যান তার বাবা আনিসুল হক। তার বাবা থাকেন নগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায়। মিতু চলে যাওয়ার পরই আত্মহত্যা করেন আকাশ। মিতু বাবার বাসায় গেলেও পরে মিতুকে গ্রেপ্তার করা হয় নন্দনকানন এলাকায় খালাতো ভাইয়ের বাসা থেকে।
গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মিতু তার বিরুদ্ধে স্বামীর পরকীয়ার সন্দেহের কথা স্বীকার করেন। এ নিয়ে বুধবার রাতে ঝগড়া ও হাতাহাতির কথাও স্বীকার করেন। কিন্তু হোটেলে রাত কাটানোসহ কিছু বিষয় নিয়ে রহস্যময় জবাব দিচ্ছেন।
স্ত্রীর পরকীয়ার স্বামীর আত্মহত্যার এ ঘটনাটি এখনো আলোচনার খোরাক ছড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে। ডা. আকাশের জন্য সমবেদনা জানাচ্ছেন সিংহভাগ মানুষ, আর মিতুর প্রতি জানাচ্ছেন ধিক্কার। মিতুর বেপরোয়া জীবন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি, প্রকাশ পাচ্ছে ঘৃণা।