তোষিকে কাইফু : ২১ ফেব্র“য়ারি তৃতীয় বারের মতো জাতিসংঘ সদরদপ্তরে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক আবহে উদযাপন করা হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগ, ইউনেস্কোর নিউইয়র্কস্থ কার্যালয়, জাতিসংঘ পোস্টাল বিভাগ, জাতিসংঘ সচিবালয়ের বহুভাষাবাদ সমন্বয়কারী কার্যালয়, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র অফিস এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনসহ গুয়েতেমালা, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি মিশনের যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় সময় বিকাল পাঁচটায় জাতিসংঘ সদরদপ্তরের কনফারেন্স রুম-২ এ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-এই দুই পর্বে বিভক্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ আয়োজনের শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। আলোচনা পর্বে অংশ নেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. এ এফ এম রুহুল হক এমপি, জাতিসংঘে নিযুক্ত মোজাম্বিকের স্থায়ী প্রতিনিধি অ্যান্তোনিও গুমেন্ডি, পাপুয়া নিউগিনির স্থায়ী প্রতিনিধি ম্যাক্স হুফানেন, নাইজেরিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি তাইজানি মোহাম্মাদ ব্যান্দে, গুয়েতেমালার উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি ওমর ক্যাস্টানেডা এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে জাতিসংঘের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিজ্ অ্যালিসন স্মেল, ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের পক্ষে নিউইয়র্কস্থ ইউনেস্কো অফিসের পরিচালক মিজ্ মারিয়ে পাওলি রোউডিল, জাতিসংঘ পোস্টাল বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এর পক্ষে জাতিসংঘের অপারেশনাল সাপোর্ট বিভাগের প্রশাসন পরিদপ্তরের পরিচালক প্যাট্রিক ক্যারে। এছাড়া ডা. এ এফ এম রুহুল হক এমপি’র নেতৃত্বে জাতিসংঘে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) এর বার্ষিক শুনানিতে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্ক সফররত বাংলাদেশের সংসদ সদস্য মো: আবু জহির এবং আহসান আদেলুর রহমান অনুষ্ঠানটিতে অংশগ্রহণ করেন। আলোচকগণ পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, বহুভাষিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাহন হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তাঁরা নিজ নিজ দেশের ভাষাগত বৈচিত্র এর সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। এছাড়া আলোচকগণ বাঙালির ভাষা আন্দোলন এবং এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে বাংলাদেশের অদম্য নেতৃত্বের কথা তুলে ধরেন। প্রতিবছর জাতিসংঘে এ দিবসটি উদযাপনে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বিশেষ ভূমিকার কথাও উঠে আসে জাতিসংঘের প্রতিনিধি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের স্থায়ী প্রতিনিধিদের বক্তব্যে। স্বাগত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের ভাষা এবং সপ্তম জনপ্রিয় ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত প্রস্তাবটি পুনরায় উত্থাপন করেন। স্থায়ী প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ছাত্রনেতা হিসেবে ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা এবং কিভাবে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা তুলে ধরার পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জাতির পিতার প্রথম বাংলায় ভাষণ এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিবছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ শে ফেব্রয়ারিকে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কথাও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। এবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য “উন্নয়ন, শান্তি ও সমন্বয়ের একটি গুণনীয়ক হিসেবে দেশীয় ভাষা” উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি আন্তর্জাতিক দেশীয় ভাষা বর্ষ ২০১৯ কে আরও এগিয়ে নিবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. এ এফ এম রুহুল হক, এমপি বলেন, “বাংলাদেশ বহুভাষাভাষী, বহু সংস্কৃতির এবং বহুধর্মের একটি দেশ।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের স্বতন্ত্র পরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি ও সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি সমেত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথা সংরক্ষণ করতে আমরা দেশের তিনটি পার্বত্য এলাকাসহ সারাদেশে ৭টি বিশেষায়িত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছি। বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছি”। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইউনেস্কো কালচালার ডাইভারসিটি মেডেল প্রাপ্তির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে ভাষণ দেন জাতিসংঘের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিজ্ অ্যালিসন স্মেল। বিশ্বের ৭ হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় ৪০ ভাগই আজ হুমকির সম্মুখীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকের দিনটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র সংরক্ষণে আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়”। বহুভাষাবাদকে জাতিসংঘের ডিএনএ উল্লেখ করে তিনি বলেন “এবছরকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘আন্তর্জাতিক দেশীয় ভাষা বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে যা বৈশ্বিকভাবে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টিতে আমাদেরকে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে”। মিজ্ অ্যালিসন স্মেল তাঁর বিভাগ কীভাবে বহুভাষাবাদের প্রচার ও বিস্তৃতিতে কাজ করছে তা উল্লেখ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের বাণী পড়ে শোনান নিউইয়র্কস্থ ইউনেস্কো অফিসের পরিচালক মিজ্ মারিয়ে পাওলি রোউডিল এবং নিউইয়র্ক সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাসিও এর বাণী পাঠ করেন নিউইয়র্ক সিটি মেয়র কার্যালয়ের ডেপুটি কমিশনার এ্যাইসসাতা কামারা। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের পোস্টাল বিভাগ বাংলাসহ ৪১টি ভাষা নিয়ে একটি স্মারক ডাকটিকেট উন্মোচন করে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মার স্মরণে এবং সাম্প্রতিক রাজধানী ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। আলোচনা পর্ব শেষে এবং সাংস্কৃতিক পর্বের আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উপর একটি প্রামাণ্য ভিডিও চিত্র অনুষ্ঠানটিতে পরিবেশন করা হয়। বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্রের চিন্ময় গ্রুপ, জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক স্কুলের শিক্ষার্থী, জাতিসংঘের ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কমিউনিকেশন্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণসহ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তাদের সন্তানেরা। বিভিন্ন ভাষার গান আবৃত্তি দিয়ে সাজানো সাংস্কৃতিক পর্বটি উপস্থিত সুধীজনদের মূহু মূহু করতালিতে অভিনন্দিত হয়। অনুষ্ঠানটিতে জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবর্গ ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাগণের পাশাপাশি নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামজিক ব্যক্তিত্ব এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।