দেশের খবর: উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা নিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা, পরিচালক ও মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান জড়িত। আর তাদের কারণে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। বিমান নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনে বিমানে ৮ ধরনের দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রতিবেদন রবিবার (৩ মার্চ) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতিবাজরা প্রশ্রয় পাবে না। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ৮ ধরনের দুর্নীতির মধ্যে আছে :
১. উড়োজাহাজ কেনা ও লিজ নেওয়া নিয়ে দুর্নীতি ২. রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিং নিয়ে দুর্নীতি ৩. গ্রাউন্ড সার্ভিস নিয়ে দুর্নীতি ৪. কার্গো এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট নিয়ে দুর্নীতি ৫. প্যাসেঞ্জার নিয়ে দুর্নীতি ৬. অতিরিক্ত ব্যাগেজের চার্জ আত্মসাৎ ৭. টিকিট বিক্রি নিয়ে দুর্নীতি এবং ৮. বিমানের ফুড ক্যাটারিং নিয়ে দুর্নীতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উড়োজাহাজের খুচরা যন্ত্রাংশ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্টস কেনা নিয়ে বিপুল অংকের অবৈধ লেনদেন হয়। উড়োজাহাজ কেনা ও লিজ নিয়েও চলে দুর্নীতি। ঠিকানাবিহীন কম্পিউটার-নেট সর্বস্ব মধ্যস্থতাকারী কিছু প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত। বিমানের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কিছু বোর্ড পরিচালক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির জাল বিস্তার করেছে। আর এতে করে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ ও সরকারি নিরীক্ষা হিসাবে গোঁজামিল পেলেও দুর্নীতিবাজদের কিছুই হচ্ছে না।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, যন্ত্রাংশের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে দুর্নীতিবাজরা।’
উড়োজাহাজ কেনা ও লিজ নেওয়ায় নামি কোম্পানিকে সুযোগ দেওয়া হয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।’ প্রতিবেদনে রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিং নিয়ে নানা দুর্নীতির তথ্য উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ‘উড়োজাহাজ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটায় শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে। বিমানের বোর্ড পরিচালক ও কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য তাদের পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ করে কার্যাদেশ দিয়ে থাকেন। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ অতি উচ্চ মূল্যে ক্রয় দেখিয়ে ঠিকাদার ও ম্যানুফ্যাকচারার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়।’
প্রতিবেদনে গ্রাউন্ড সার্ভিস নিয়ে দুর্নীতির তথ্যে বলা হয়, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুর্নীতির অন্যতম খাত হলো গ্রাউন্ড সার্ভিস খাত । ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বেশি দামে নিম্নমানের ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় করা হয়। অদক্ষতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট না কিনে অপ্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট কেনা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের মূল্যবান উপকরণও বিক্রি করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং স্টাফ নিয়োগেও চলে ব্যাপক দুর্নীতি। এতে দিন দিন বাংলাদেশ বিমান অদক্ষ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারে পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে কার্গো এক্সপোর্ট ও ইমপোর্ট নিয়ে দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়, ‘বিমানের আয়ের একটি বড় খাত হলো কার্গো সার্ভিস। কিন্তু এই খাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কোটি কোটি টাকা এয়ারওয়ে বিল কম পাচ্ছে। অনেক সময় বিমানের কার্গো সার্ভিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী আমদানি-রফতানিকারকদের যোগসাজশে ওজনে কম দেখিয়ে, আবার কখনও একক পরিবর্তন করে (টন কে সিএফটি, সিএফটি কে টন) কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়া আমদানি ও রফতানি পণ্যের ওজন ও ভলিউম রেকর্ডভিত্তিক কম দেখিয়েও বেশি পরিমাণ মালামাল বিমানে ওঠানো হয়। এই অতিরিক্ত টাকা আমদানি/রফতানিকারকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করা হয়।’ প্যাসেঞ্জার খাতের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার ও লে-ওভার প্যাসেঞ্জারের হিসেব এদিক-সেদিক করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। প্রতিদিন ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা যতজন হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখিয়ে খাবারের বিল করে অতিরিক্ত টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। লে-ওভার প্যাসেঞ্জারদের জন্য নিয়ম অনুযায়ী হোটেলের প্রতি রুমে একজন রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবে প্রতি রুমে ৪/৫ জন রাখা হয়। আর বিল তৈরি করা হয় জনপ্রতি। অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্যতা অনুযায়ী প্যাসেঞ্জারদেরকে খাবার ও হোটেল দেওয়া হয় না, কিন্তু যথারীতি বিল করে টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়।’
প্রতিবেদনে অতিরিক্ত ব্যাগেজের চার্জ আত্মসাতের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘যাত্রীরা অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যাগেজ নিয়ে বিমানে উঠেন। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যাগেজের জন্য যাত্রীর কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ নিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। অন্যদিকে যাত্রীদের বুকিং ট্যাগ এবং ফ্লাইট ডিটেইলে অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শন করা হয় না। এতে আরও দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রথমত, কোনও যাত্রীর ব্যাগ মিসিং হলে তিনি ট্যাগ না থাকার কারণে অতিরিক্ত ওজনের অংশের ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হন। দ্বিতীয়ত, ফ্লাইট ডিটেইলে সঠিক ওজন ইনপুট না দেওয়ার কারণে ফ্লাইট মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে।’
টিকিট বিক্রি নিয়ে দুর্নীতির প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রায়ই বাংলাদেশ বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না। এমনকি অনলাইনেও টিকিট পাওয়া যায় না। অথচ বাস্তবে বিমানের আসন খালি যায়। এমনটা হওয়ার কারণ, অন্যান্য এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগসাজশ করে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের বেশি টিকিট বিক্রির সুবিধা করে দেওয়া হয়। ’
প্রতিবেদনে বিমান ফুড ক্যাটারিং নিয়ে দুর্নীতির তথ্যে বলা হয়, ‘নিম্নমানের খাবার পরিবেশন হয়। এ নিয়ে কোনও নজরদারি নেই। প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, কোথা থেকে কিভাবে খাবার কেনা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা জরুরি।’