শিক্ষা ডেস্ক: রাত পোহালেই নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী। দীর্ঘ ২৮ বছর বন্ধ থাকার পর আগামীকাল (১১ মার্চ) খুলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ( ডাকসু)’র বন্ধ দুয়ার।
ভোট সকাল আটটায়, চলবে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। তবে ২টার মধ্যে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকা সকলের ভোট গ্রহন করা হবে। সেক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের সময়সীমা একটু বাড়তে পারে। তারপর গণণা শেষে প্রকাশিত হবে শিক্ষার্থীদের রায়। এরই মধ্যে গতকাল রাতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যান্য সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। শেষ দিনে ছিল প্রার্থী ও ভোটারদের শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ। শঙ্কা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরব ছিল সবাই। সকলের প্রত্যাশা উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু ভোট।
বেশ কিছু শঙ্কা ও উদ্বেগের কথা জানা যায় প্রার্থী ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে। তাদের ওই উদ্বেগের বড় কারণ হলগুলোতে সহাবস্থানের বদলে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য বহাল থাকা। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া ছয় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সবাই ভোট দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। যদিও প্রশাসন বলছে, দুপুর ২টার মধ্যে যারা হলে প্রবেশ করবে তারা সবাই ভোট দিতে পারবে। এ ছাড়া ভোটের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলো ঠিকমতো চলবে কি না, সেটাও অনাবাসিক ভোটারদের উদ্বেগের বড় বিষয় হয়ে আছে।
রোকেয়া হলের কারুশিল্প বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী মিফতু মনি হক মৌ বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে না বলেই মনে হচ্ছে। কারণ হলের ভেতরে ভোটকেন্দ্র, যেকোনো দলেরই নিয়ন্ত্রণ নেবার সুযোগ থাকবে। এ জন্য শঙ্কা কাজ করছে। ’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের অনাবাসিক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ‘যদি আগে থেকে ভোট প্রদানের লাইন পূর্ণ থাকে, তাহলে অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা কীভাবে ২টার মধ্যে লাইনে দাঁড়াবে। একজন ভোটারের ৩৮টি করে ভোট দিতে হবে, যা দু-চার মিনিটে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাবাসসুম তাব্রীজ বলেন, ‘উৎসবের সঙ্গে শঙ্কাও রয়েছে—আমরা সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারব কি না! যদি সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারি তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মনে আশা জাগবে।
ভোটাধিকার হনন করা হলে দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রগতিশীল ছাত্রঐক্যের প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, যদি একজনেরও ভোটাধিকার হনন করা হয়, তবে প্রশাসনকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে। প্রশাসন নীলনকশা করছে। আমাদের দাবি প্রতি রুটে ১০টি করে বাস দিতে হবে। সকাল সকাল যেন বাসগুলো দেওয়া হয়। সকলকে অনুরোধ আপনারা আপনাদের ভেটাধিকার প্রয়োগ করবেন। পোলিং এজেন্ট দিতে হবে।
লিটন আরও বলেন, মিডিয়ার উপর যে সেন্সরশীপ দেওয়া হয়েছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে। লাইভ সম্প্রচার করতে দিতে হবে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দিতে হবে।
ভোট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বশেষ নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বশেষ নির্দেশনা নিয়েও শঙ্কা কাজ করছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভোট কক্ষের অভ্যন্তরে কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট থাকতে পারবে না। ২২৯ জন প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট থাকলে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না। তবে গণনার সময় পোলিং এজেন্টরা থাকতে পারবে। সাংবাদিকরা প্রতিটি হলের নির্ধারিত জায়গায় অবস্থান নিতে পারবেন। তাঁরা ভোটকেন্দ্রের ছবি নিতে পারবেন, তবে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন না।
কয়েকজন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে, সেজন্য সব ব্যবস্থাই তারা নিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার আশ্বাসও দেন তারা।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, থাকছে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা মহানগর পুলিশ। এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল উৎসবমুখর করার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সুদৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ডাকসু নির্বাচন ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করেছি। ১৮টি হলে ১১৩টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে, এসব ক্যামেরা দিয়ে নির্বাচনের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
নিরাপত্তা প্রসঙ্গে প্রক্টর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী, হাউস টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল বডি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইল টিম, মোবাইল পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন আমরা ভোটের অপেক্ষায় রয়েছি। নিরাপত্তা, ব্যালট, প্রার্থিতা, হল ম্যানেজমেন্ট, বুথ ও কেন্দ্র সব নির্ধারিত হয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ডিএমপি। তিনি জানান, নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভোটকেন্দ্র ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) আওতায় থাকবে। প্রবেশমুখে বসানো হবে চেকপোস্ট। নিয়ন্ত্রণে থাকবে সাধারণ যান চলাচল। ডাকসু নেতরা ছিলেন দেশের ক্রান্তিকালের ত্রাতা দেশের ক্রান্তিকালে সবসময়ই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ডাকসুর নেতারা। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন ডাকসুর মেধাবী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই বেগবান হয়েছে। স্বাধীনতা অন্দোলনের সূচনালগ্নে, ’৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনে ডাকসুর নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। সেই সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসুর ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান। এ ছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সুলতান-মুশতাক পরিষদ ও আমান-খোকন পরিষদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
‘৫২-র ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছে ডাকসু। ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছর পরই যাত্রা শুরু করে ডাকসু। একসময়ের ডাকসুর নির্দেশিত আন্দোলনের ফলেই বাংলাদেশ আজ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে বন্ধ ছিল ডাকসু নির্বাচন। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ভুলতে বসে ঐতিহ্যময় ডাকসুর কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, একটি জাতি সৃষ্টির কারিগর এমন মহাসত্যও চাপা পড়ে গিয়েছিল ডাকসুর অবর্তমানে।সাবেক ২৫ শিক্ষার্থীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চআদালতের রায়ে ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাধ্য হয় নির্বাচন দিতে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন।