বিদেশের খবর: রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ, গুলি, ইভিএম ভাংচুরের মধ্য দিয়ে শেষ হল ভারতের প্রথম দফার ভোটগ্রহণ।
দীর্ঘ ৩৯ দিনের এ কর্মযজ্ঞের প্রথম দিনেই রক্তাক্ত হল উৎসবের ভোট। অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় দলের দুই নেতা নিহত হয়েছেন।
রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলি, মাওবাদী হামলা, ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভাংচুর, সহিংসতায় প্রাণহানিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় উত্তপ্ত হয়েছে ভোটের মাঠ। ছিল নির্বাচনের পুরনো অভিযোগ- ভোট কারচুপি। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনের বিকল হওয়ার ঘটনা। রাজস্থান ও ছত্রিশগড়ে ভোট বানচালের চেষ্টায় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মাওবাদীরা। নির্বাচনী নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে আটক হয়েছেন নেতাকর্মীরা।
বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় ১৮টি রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ৯১টি লোকসভা আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। রাজ্যগুলো হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ (২৫), অরুণাচল প্রদেশ (২), আসাম (৫), বিহার (৪), ছত্তিশগড় (১), জম্মু ও কাশ্মীর (২), মহারাষ্ট্র (৭), মনিপুর (১), মেঘালয় (২), মিজোরাম (১), নাগাল্যান্ড (১), উড়িষ্যা (৪), সিকিম (১), তেলেঙ্গানা (১৭), ত্রিপুরা (১), উত্তরপ্রদেশ (৫), উত্তরাখন্ড (৫), পশ্চিমবঙ্গ (২), আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (১) এবং লাক্ষাদ্বীপ (১)। এদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। কোনো কোনো কেন্দ্রে ইভিএম বিড়ম্বনায় বিলম্ব হয়েছে।
ভোটের শুরুতেই ছিল ইভিএম বিতর্ক। ভোট বুথ থেকে এসেছে ভূরি ভূরি অভিযোগ। কেউ বলছে, ইভিএম নষ্ট। কারও মুখে বিরোধী দলের বাটন কাজ করছে না। অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য থেকেই প্রথম অভিযোগ আসে। সেখানে ৩৬২টি ইভিএম খারাপের কথা স্বীকার করে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসিআই)। ভোট মেশিন নষ্টের অভিযোগ তুলে ১৫০ বুথে ফের ভোটের দাবি জানিয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি বলেন, রাজ্যের অন্তত ৩০ শতাংশ ইভিএম কাজ করছে না।
এনডিটিভি জানায়, মহারাষ্ট্রে ইভিএমে গড়বড় ও কারচুপির অন্তত ৩৯টি অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। রাজ্যের ৭টি আসনের মধ্যে ৬টিতে ইভিএম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে ভারতের প্রাচীন এ দলটি।
জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ কেন্দ্রে কংগ্রেস দলের ইভিএম বাটন কাজ করছে না বলে জানিয়েছেন রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। টুইটারে একটি ভিডিও শেয়ার করে তিনি বলেন, পুঞ্চের ৬টি বুথে কংগ্রেসের বাটন নষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে ইভিএম কারচুপির অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেসও। এদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত শুধু এ রাজ্যেই কমিশনের অফিসে মোট ৪৬২টি অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে ৪৩৬টি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেছে কমিশন জানিয়েছে। এছাড়া বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, তেলেঙ্গানা, উড়িষ্যার ইভিএম মেশিন বিকল হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ইভিএম ভাংচুর : পশ্চিমবঙ্গে সকালে ভোট চলার মধ্যেই রাজ্যের দিনহাটায় একটি বুথে ঢুকে ইভিএম, ভিভিপ্যাট ভাংচুরের ঘটনায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এ ঘটনায় বিজেপি-তৃণমূল একে অপরকে দোষারোপ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের দুটি কেন্দ্র কোচবিহার ও অলিপুরদুয়ারে ভোট হয়েছে। দুই আসনেই মূল লড়াই তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মধ্যে। কোচবিহারের তুফানগঞ্জে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল ও বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন বিজেপি কর্মীর গুরুতর জখম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি কার্যালয় ভেঙে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে।
ওদিকে কংগ্রেস কোচবিহারে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের বিরুদ্ধে ভোটে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলেছে। তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ জানিয়েছেন, নিয়ম না মেনে বুথের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন বিএসএফ জওয়ানরা। পাশাপাশি ইভিএম কারচুপির অভিযোগও তুলেছেন তিনি।
অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাণহানি : প্রথম দফার ভোটেই রক্ত ঝরেছে অন্ধ্রপ্রদেশে। রাজ্যটির ভেরাপুরাম গ্রামের তাড়িপাত্রী কেন্দ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং টিডিপি সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় দলের দুই নেতা নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, টিডিপি দলের সিদ্ধা ভাস্কর রেড্ডি ও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের পুল্লা রেড্ডি। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের অভিযোগ, কেন্দ্রে কারচুপি করার চেষ্টা করছিল টিডিপির এমএলএ জেসি প্রভাকর রেড্ডি ও এমপি জেসি দিভাকর রেড্ডি। এ সময় উভয় দলের নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পাল্টাপাল্টি বেধড়ক মারধরে নিহত হয়েছেন দুই দলের দুই নেতা। উত্তাল ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর। সকাল থেকেই অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন বুথে ইভিএমের গণ্ডগোলের জন্য ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে, যা নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে কলহ চরমে ওঠে। অনন্তপুরে গুন্তাকাল বুথে জনসেনা পার্টির প্রার্থী মধুসূদন গুপ্তা ভোটকেন্দ্রে পৌঁছলে বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে তার বিবাদ শুরু হয়। পরে তা হাতাহাতি ও সংঘর্ষে রূপ নেয়। এরই জের ধরে একপর্যায়ে কেন্দ্রের ইভিএম মেশিন মাটিতে ছুড়ে ফেলেন মধুসূদন। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ত্রিপুরায় বিজেপি ও কংগ্রেস সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ছত্রিশগড় ও মহারাষ্ট্রে বোমা বিস্ফোরণ : ছত্রিশগড় ও মহারাষ্ট্রে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভোট বানচালের চেষ্টা করেছে মাওবাদীরা। মহারাষ্ট্রে গড়চিরৌলি বুথের কাছে আইইডি (ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটেছে। গড়চিরৌলি জেলার একটা পল্লীতে একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সামনে এ হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর জেলার বস্তার লোকসভা কেন্দ্রে ভোটের দিন সকালে মাওবাদী-সেনা সংঘর্ষ হয়েছে। চলেছে গোলাগুলি। নারায়ণপুরে আইটিবিপি জওয়ানদের একটি কনভয় ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার সময় হামলা চালায় মাওবাদীরা। পাল্টা গুলি চালিয়ে মাওবাদীদের দলটিকে হটিয়ে দেন জওয়ানরা।
উত্তরপ্রদেশে ভুয়া ভোটার ঠেকাতে গুলি : উত্তরপ্রদেশের কৈরানায় ভুয়া ভোটারদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালিয়েছে বিএসএফ। ২০-২৫ জন ভুয়া ভোটার ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তাদের কারও কাছে পরিচয়পত্র ছিল না। তারা আক্রমণাত্মক আচরণ করায় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিএসএফ জওয়ানরা। কিছুক্ষণের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ফের শুরু হয় ভোটগ্রহণ।
পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে তৃণমূল কংগ্রেসের হামলায় ভারতীয় জনতা পার্টির চার সমর্থক আহত হয়েছেন। অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু দেশম পার্টির এক প্রার্থী বিরোধীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। এই প্রদেশে জনসেনা পার্টির একটি প্রার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভেঙে ফেলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ভোটচিত্র ও ইসিআই’র বক্তব্য : ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ইভিএম নিয়ে কয়েকটি রাজ্য থেকে অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে ৬, অরুণাচলে ৫, মনিপুরে ২, বিহারে ও পশ্চিমবঙ্গে ১টি করে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উত্তরপ্রদেশের ৫টি আসনে ভোট হয়েছে। সেখানে মূল লড়াই এসপি, বিএসপি এবং আরএলডির মহাজোটের সঙ্গে বিজেপির। এ রাজ্যে ৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যে ২টি আসনে ভোট হয়েছে, সেই কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারে মূল লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির। বিকাল ৩টা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে ভোট পড়েছে ৭১ শতাংশ, কোচবিহারে ৬৮ শতাংশ। উত্তরাখন্ডে ৪৬, মনিপুরে ৬৮ এবং লক্ষদ্বীপে ৬৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।
ভারতজুড়ে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ হবে ১৮ এপ্রিল। এরপর ২৩ এপ্রিল তৃতীয় দফা, ২৯ এপ্রিল চতুর্থ দফা, ৬ মে পঞ্চম, ১২ মে ষষ্ঠ দফা ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ১৯ মে তে শেষ হবে সাত দফার ভোটগ্রহণ। ২৩ মে ভোট গণনার পর ফল ঘোষণা করবে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। সরকার গঠনের জন্য ২৭২টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে যে কোনো দলকে।