রাজনীতির খবর: আমার সৌভাগ্য নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরও দলটাকে ক্ষমতায় রাখতে পারছি- এমন মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা এবং ১/১১ সময়ের দলের ভিতরের ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
গতকাল বিকালে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে এ কথা বলেন। বৈঠকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুকুল বোস আরেক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিক্ষাবিদ ড. খন্দকার বজলুল হকের নাম নিয়ে বলেন, জাতির পিতার হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে এই খন্দকার বজলুল হকের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগের বড় নেতা। অনেক কথা বলেন। অন্যদিকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খানের নাম উল্লেখ করে মুকুল বোস বলেন, তিনি পাকিস্তানের আর্মি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রংপুরে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকিস্তানে চলে যান। তিনি এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, থামো, তুমি তো একটা একটা করে বলছ। আমার কাছে অনেক তথ্য আছে। অনেকে অনেক কিছুই করেনি। ১৯৭৫ সালের পর কে কী করেছে তা আমার জানা আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু ’৭৫-এর কেন, ১/১১ সময়ে কে কী করেছে আমার মনে নেই? কার কী ভূমিকা ছিল তা জানি। আমার সামনেই তো অনেকে আছে। আমি তো মন্ত্রীও বানিয়েছি। কিন্তু আমি কি ভুলে গেছি কার কী ভূমিকা ছিল? আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে, এত কিছু ষড়যন্ত্রের পরও দলটাকে ক্ষমতায় রাখতে পারছি। উপস্থিত একাধিক নেতা এসব কথা জানান। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুকুল বোসও ওই কথা বলেছেন বলে স্বীকার করেন। তবে মুকুল বোসের কথা প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবে গ্রহণ করেননি বলে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান। তবে বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও ড. খন্দকার বজলুল হক ও কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান কোনো কথা বলেননি বলে জানা গেছে।
পিছিয়ে যাচ্ছে সাংগঠনিক সফর : রমজানের আগে রংপুরের তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল সফরের কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে না। ২৪ এপ্রিল থেকে জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হলে স্থানীয় এমপিরা ঢাকায় থাকবেন। আর ৭ মে থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। এসব মাথায় রেখে আগামী ঈদের আগে তৃণমূল সফরে আপাতত না আওয়ামী লীগের। গতকাল দলটির উপদেষ্টা পরিষদ ও কার্যনির্বাহী সংসদের যৌথসভায় এমনটাই উঠে এসেছে আলোচনায়। সভায় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান সাংগঠনিক সফরের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২৪ এপ্রিল থেকে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসছে। এমপিরা অধিবেশনে যোগ দেবেন। সে কারণে সংসদ শেষ হলে সাংগঠনিক সফরে বের হতে হবে। একই সঙ্গে সম্মেলনও করতে হবে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য জাতীয় কমিটির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জেলা-মহানগর পর্যায়ে কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মুজিব বর্ষ একেবারে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপক কর্মসূচি নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, এইচ টি ইমাম, এস এ মালেক, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মুকুল বোস, মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, আহমদ হোসেনসহ দলের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তৃতা করেন।
তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানো হবে : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। এ জন্য আমরা আট বিভাগের জন্য আটটি কমিটি করেছি। এ কমিটিগুলোর দায়িত্ব থাকবে তৃণমূলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। গতকাল বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভার সূচনা বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আজকে উপদেষ্টা পরিষদ এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ একসঙ্গে বসেছি। সেই সঙ্গে আমরা আরেকটি কাজ করতে চাই, ইতিমধ্যে আমাদের প্রেসিডিয়াম মিটিং করেছি, ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করেছি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, প্রেসিডিয়াম কার্যকরী সদস্যের নিয়ে আটটি বিভাগে কমিটি গঠন করেছি। তিনি বলেন, যে কমিটির দায়িত্ব থাকবে আমাদের সংগঠনগুলো একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। কোথায় কমিটি আছে না আছে সেগুলো দেখা। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে আরও মজবুত করে গড়ে তোলা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণত রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে অনেক সময় সরকার ধীরে ধীরে মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে যায় বা তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে জনগণের আস্থা বিশ্বাস আমরা অর্জন করেছি, জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৈঠক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করব। এ উদযাপনের লক্ষ্য নিয়েই আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। আমরা সরকারিভাবেও কমিটি করেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। পার্টির পক্ষেও আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি এবং আমরা একটা কমিটিও করেছি। সেই কমিটির মাধ্যমে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল। ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা উদযাপন করব। এ সময়টাকে আমরা মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আজকে এখানে আলাপ-আলোচনা করব।
জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এবারের নির্বাচন, যেটা হয়ে গেল; যদি নির্বাচনের দিকে তাকান দেখবেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। যেটা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এমনকি ব্যবসায়ী সম্প্র্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে।
কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, ছাত্র; সবচেয়ে বড় কথা যারা প্রথমবারের ভোটার, নবীন ভোটার সবাই আওয়ামী লীগ সরকারকে আবার চেয়েছে, তাদের সেবা করার জন্য, মানুষ ভোট দিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটের ভরাডুবির কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অপরদিকে বিএনপি-জামায়াতের অবস্থান- যেহেতু মিলিটারি ডিকটেটর ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় গিয়ে এসব দল গঠন করেছে, খুব স্বাভাবিকভাবে তারা হচ্ছে পরজীবীর মতো। নির্বাচনকে তারা মনে করেছে ব্যবসা। টিকিট বেচে তারা কিছু পয়সা কামাই করে নিয়েছে কিন্তু নির্বাচনের প্রতি তাদের খুব একটা নজর ছিল না।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যখন সার্ভে করা হয়েছিল, সেই সার্ভেতে তখন থেকে স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগকে জনগণ চায়। জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে এবং আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে। তারা নির্বাচন করার জন্য একটা নির্বাচন করা আর বাণিজ্য করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। যার জন্য তাদের এই হাল। বিএনপি-জামায়াত আমলের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাই হোক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এগুলোই ছিল তাদের কাজ। আজ দেশের মানুষ অন্তত শান্তি পাচ্ছে।
এবারের নববর্ষ সবাই উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদযাপন করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এবার ব্যাপকভাবে নববর্ষ উদযাপন হয়েছে। শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাই এ উৎসবটা করেছে। আমরা কিন্তু নববর্ষ ভাতাও দিচ্ছি। বাংলাদেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
জাতির পিতার অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশটা জাতির পিতার নেতৃত্বে যখন উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করে তখনই ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনা ঘটে। নির্মমভাবে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
বক্তব্যের শুরুতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ ক্ষুধামুক্ত, বাংলাদেশ আজ দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার পথে। আমরা প্রায় ৪০ ভাগ থেকে ২১ ভাগে দারিদ্র্যের হার নামিয়ে এনেছি।
মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ছে। এটাই জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল। জাতির পিতা চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ।
দলটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের সঞ্চালনায় সভায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় সব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।