নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ভারী যন্ত্রাংশ ক্রয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাটের ঘটনায় জড়িতরা এখন গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে আছেন। ইতিমধ্যে সামাজিকভাবে তারা প্রচ- চাপের মধ্যে আছেন। নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের ধারাবাহিক প্রতিবাদ সভা ও সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে দুর্নীতিবাজ চক্রটির মুখোশ উম্মোচিত হয়ে গেছে।গতকাল বুধবার নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের ঘেরাও এবং দুদকের অভিযানে দুদকের দুই মামলার আসামী এ কে এম ফজলুল হক স্টোর রুমের চাবি নিয়ে পালিয়ে যান। যদিও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন মহলে ম্যানেজ করার চেষ্টায় ব্যস্ত আছেন। অপরদিকে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান কর্তৃক কোন অনিয়ম হয়নি দাবি করলেও প্রাথমিকভাবে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুদক টিম।গত ১৭-১৮ অর্থ বছরে বরাদ্দের ১৮ কোটি টাকার পুরোটাই লোপাটের চেষ্টা করা হয়। ইতোমধ্যে ঢাকার ঠিাকাদারি প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে বিগত বছরের ২৮ জুন ৭ কোটি ৮১ লাখ ৭১ হাজার ৮৭৮ টাকা ও ৩০ অক্টোবর ২০১৮ সালে ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ টাকা দুটি চেকের বিপরিতে বিল প্রদান করা হয়েছে। খাতা কলমে এসব বিপুল পরিমান অর্থের ভারী যন্ত্রাংশ গেল বছরের ৭ জুন সার্ভে কমিটির আহবায়ক তৎকালিন আরএমও ডা. ফরহাদ জামিল, ডা. আসাদুজ্জামান ও ডা. শরিফুল ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে সৃষ্ট কাগজপত্রে দেখা যায়। সেখানে রাবার স্ট্যাম্পে সিল যুক্ত লেখায় দেখা যায় “অত্র ভাউচারের অপর পাতায় বর্ণিত সমুদয় মালামাল সঠিকভাবে ভালো অবস্থায় পাওয়া গেল-স্টক লেজারে উঠানোর জন্য বলা হল”। এরপর স্টোরকিপার এ কে এম ফজলুল হক স্বাক্ষরিত আরও একটি রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহৃত সিলে বলা হচ্ছে ‘সার্ভে বোর্ডের নির্দেশ মোতাবেক অত্র ভাউচারে সমুদয় মালামাল সঠিক ও ভাল অবস্থায় বুঝিয়া পাইয়া স্টক লেজারের বর্ণিত পাতায় যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ করা হইলো’। একটি সাদা পাতায় কথিত স্বাক্ষর আর রাবার স্ট্যাম্প সিল যুক্ত মতামত দেয়া হয়েছে। এভাবে ৪ আগষ্ট ২০১৮ তারিখে মালামাল বুঝে পাওয়ার আরও একটি এবং ২৪ অক্টোবর আরও একটি সাদা পাতায় সৃষ্ট সার্ভে কমিটির মতামত দিয়ে যন্ত্রাংশ গ্রহণের কাগজপত্র দেখা যায়। অথচ উল্লেখিত ডাক্তাররা তারা মালামাল বুঝে পাওয়া এসব কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেননি বা জানেন না বলে লিখিতভাবে গত ১১ এপ্রিল বর্তমান সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। যা বর্তমানে তদন্তাধীন। এদিকে এসব মালামাল সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি থানার উত্তর সুজাপুর গ্রামের জাহের উদ্দীন সরকার ও তার স্ত্রী নুসরাত জাহান রতœা বর্তমান ঠিকানা ২৬/এ/২ দ্বিতীয় তলা, তোপখানা রোড, সেগুন বাগিচা ঢাকা। এর মালিক ও স্বত্তাধিকারী হিসেবে মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল পরিচালনা করছেন বলে সূত্র জানায়। অপরদিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের জন্য তৎকালিন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান ১৪.০৯.২০১৭ তারিখে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টে-ার আহবান করেন। ২৩.১০.১৭ তারিখে দরপত্র দাখিল হয় এবং এদিনই দরপত্র বাক্স খোলার দিন থাকে। যথাযথ দিনে ঢাকার উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হন। ঘটনার সময়ই ছিল নানা অভিযোগ। বিভিন্ন কোম্পানিকে দরপত্র ফেলতে দেয়া হয়নি। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্রয়কৃত যন্ত্রাংশের মধ্যে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন (৫০০এমএ কোরিয়ান) যার মুল্য ২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ক্রয় করা হয়েছে, সাতক্ষীরা মেডিকেলের একাধিক সূত্রের সাথে কথা বলে জানা যায় আড়াই কোটি টাকার এই মেশিনটির মূল্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। এক্স-রে মেশিন (৩০০এমএ) ৭১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়েছে অথচ এই মেশিনটির বাজার দর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা, সিআর উইথ প্রিন্টার- মুল্য ৪৫ লক্ষ টাকা এর সর্বোচ্চ বাজার দর ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা। এক্স-রে ফ্লিম অটো প্রোসেসর মুল্য ১৯ লাখ ১৮ হাজার টাকায় ক্রয় করা হয়েছে যার বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা, সি আর ক্যাসেট (১৪১৭) ক্রয় মূল্য ৪৮ লাখ টাকা, অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সিআর ক্যাসেট (১৪১৪) ক্রয় মূল্য ৪৮ লাখ ৩ হাজার টাকা, অথচ এর বাজার মুল্য ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। পোর্ট এ্যাবল এক্স-রে মেশিন ক্রয় মুল্য ৩২ লাখ ৯০ হাজার টাকা, যার বাজার মুল্য ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। সি-আরএম এক্স-রে মেশিন ক্রয় মুল্য ৯১ লাখ টাকা কিন্তু এই মেশিনটির বাজার মুল্য ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। আল্ট্রাসনো গ্রাফি মেশিন (২/৩) ক্রয় মুল্য ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এই মেশিনটির বাজার দর ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কালার ডপলার আল্ট্রা সাউন্ড (ফোর ডি) ক্রয় মুল্য ১কোটি ১২ লাখ টাকা, এই মেশিনটির বাজার দর ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকা। ইসিজি মেশিন (১২ চ্যানেল) ক্রয় মূল্য ৪ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। এই মেশিনটির বাজার মূল্য বর্তমানে এক লাখ টাকার উপরে। বেড সাইড মনিটর ক্রয় মূল্য ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা। এই মেশিনটির বাজার মুল্য ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। আইসিইউ ভেনটিলেটর মেশিন ক্রয় মুল্য ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই মেশিনটির বাজার মূল্য ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এরপরও বলা দরকার সাতক্ষীরা জেলার কোন সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় এই মেশিন ব্যবহার করার কোন সুযোগ নাই। এখন বিপুল অংকে ক্রয় করা এই মেশিন সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান কোথায় খাটাবেন তা জানা দরকার। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, যা হাসপাতালে আসা রুগীদের বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রস্তুত করার যন্ত্র। যেগুলো প্রতিটা ওয়ার্ডের সামনে একটা করে ট্যাব সিস্টেম করা থাকবে। এই মেশিনটি ক্রয় করা হয়েছে ২০ লাখ ৯ হাজার টাকা। তবে এর বাজার মুল্য কত হবে তা সাধারণ মানুষ অবশ্যই বলতে পারবেন। কারণ এগুলো শহরের অনেক স্থানে লাগানো আছে। ক্রয় করা হয়েছে স্ক্র ড্রাইভার (৪.৫) যার মুল্য ২ হাজার ৮০ টাকা। এটি ফুটপাতে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় পাওয়া যায়।এভাবে সরকারের দেয়া বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাজার দরের ৪ থেকে ৬ গুন বেশি মুল্যে ক্রয় করা হয়েছে। আর ক্রয়কৃত পণ্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সাতক্ষীরার তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, স্টোর কিপার এ কে এম ফজলুল হক ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের কমিশন বাণিজ্য তো জমেছে। একই সাথে গেল ১৮ সালে কোন যন্ত্রাংশ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে না আসলেও খাতা কলমে তা বুঝে নেয়ার কাগজপত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর চলতি মাসের ৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে উপ-সচিব হাছান মাহমুদসহ ৩ সদস্যের টিম সদর হাসপাতালে আকস্মিক পরিদর্শন করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। এরপর সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সভা এবং সপ্তাহব্যাপী ধারাবাহিক কর্মসূচির শেষে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও করে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ। ইতিমধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অর্থ লোপাটের সাথে জড়িতদের বিচারের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।