নিজস্ব প্রতিবেদক: কোটি কোটি টাকার মালিক সামান্য একজন স্টোর কিপার ফজলু। এজন্য আলাদীনের চেরাগ। গরিব রোগীরা যেখানে ঠিকমত ওষুধ পায়না সেখানে ফজলু গরিবের ওষুধ বিক্রি করে সম্পদের পাহাড় জমান। বার বার চাকুরি থেকে বরখাস্ত ও দুই বার দুদকের অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের আলোচিত দুর্নীতিবাজ স্টোর কিপার এ কে এম ফজলুল হক বহাল তবিয়েতে আছেন। সম্প্রতি গত ২৪ এপ্রিল বুধবার নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও এবং দুদকের অভিযানের সময় সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের এই বিতর্কিত স্টোরকিপারের স্টোরের চাবি নিয়ে পালিয়ে যান।
এই ফজলু দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হলেও বার বার ফিরে পেয়েছেন চাকুরি। আর চাকুরিতে ফিরেই পূর্বের থেকে বেশি মাত্রায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। দুর্নীতি ও লুটপাটের টাকায় সাতক্ষীরা জেলা শহরে গড়ে তুলেছেন নিজের নামে ও স্ত্রীর নামে বিলাশ বহুল দুটি বাড়ি। স্টোর কিপারের চাকুরি করে জমিয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। আর এবার সেই দুর্নীতির মাত্রায় যোগ হলো প্রায় ১৯ কোটি টাকার সারঞ্জাম লুটপাটের খবর। আলোচিত এ নামের সাথে যুক্ত সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেন ও প্রাক্তন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান। যা বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ ও ২০১৭ দুদকের মামলায় দুই দফা গ্রোপ্তার হয়ে চাকুরিচ্যুত হন ফজলুল হক।
সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সেবার মান উন্নত করতে বরাদ্দের ১৯ কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই লুট হয়ে গেছে! ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে প্রথম দফায় ৯ কোটি টাকা এবং পরে আরও দুইবার বাড়িয়ে সর্বমোট প্রায় ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের ভিত্তিতে যে সকল ভারী যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার কথা সেসব সরবরাহ না করলেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়ে গেছে। ৯ এপ্রিল সকালে উপ-সচিব হাছান মাহমুদসহ ৩ সদস্যের একটি টিম আকষ্মিক ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় এসে বরাদ্দকৃত টাকার ভারী যন্ত্রাংশ দেখতে চাইলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। সূত্র জানায়, সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, স্টোর কিপার একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন সময়ে কর্মকতরা ভাগ বটেয়ারা করে নিয়েছে। তবে এখন কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এসব পণ্য বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির সদস্য ডা. ফরহাদ জামিল, ডা. আসাদুজ্জামান (মেডিসিন) ও ডা. শরিফুল ইসলাম (সার্জন) যদিও ৩ জনই ব্যাপারটি জানেন না বলে পরিদর্শন কমিটিকে জানান। একই সাথে তাদের স্বাক্ষর দেখে নকল বলেও ৩ জনই দাবি করে লিখিত দিয়েছেন। সূত্র আরো জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সময়ে উক্ত টাকার টেন্ডার আহবান করা হয়। সে অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন্টাইল ট্রেড কোং আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তারা এসব মমালামাল সরবরাহ করেছেন, পোর্টএ্যাবল এক্স-রে মেশিন ৪টি। যার প্রতিটির মূল্য ২৩ লাখ টাকা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন ৪টি, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, নেবু লাইজার মেশিন ১৮টি, স্টীল ল্যাম্প ১টি, চক্ষু পরীক্ষার মেশিন ১টি। যা প্রায় ৮৫ হাজার টাকা দাম, রেটিনোস্কপ ১টি, ডেন্টাল যন্ত্রাংশ এক সেট, সাকশান ইউনিট ১টি ও ওয়াটার বাথ রয়েছে। এসব পণ্য চলতি অর্থ বছরের বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে আসার কথা থাকলেও কোন যন্ত্রাংশই এখানে আসেনি, ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন এর খুলনা অফিস বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২১ জুন সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয় এলাকা থেকে ফজলুল হককে গ্রেপ্তার করে করা হয়। দুদক সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা রিজার্ভ স্টোরের সরকারি ওষুধ আত্মসাৎ ও আত্মসাতে সহায়তায় তৎকালীন সিভিল সার্জন নাজমুল হক ও স্টোর কিপার এ কে এম ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে দুদক কর্মকর্তারা ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ওষুধ ঢাকা থেকে গ্রহণ করে তা চুয়াডাঙ্গা রিজার্ভ স্টোরে মজুদ না করে বিক্রি করে দেন। এই অভিযোগে দ-বিধির ৪০৮/১০৯ এবং ১৯৭৪ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলা করা হয়। দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলাম মোড়ল বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে ওই দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার হলে তিনি আরো বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের ৭ কোটি ১০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা মূল্যের এমএসআর সামগ্রী আত্মসাতের ঘটনায় প্রাক্তন সিভিল সার্জন (অবঃ) ডাঃ সালেহ আহমেদ ও অফিসের স্টোর কিপার ফজলুল হকের বিরুদ্ধে দুদক ২০১৭ সালের ২১ মে রবিবার সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এ ঘটনায় স্টোর কিপার ফজলুল হককে গ্রেফতার করেছে দুদক। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল-২ অধিশাখা বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৫ টাকার ক্রয়কৃত এমএসআর মালামাল সামগ্রী সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ সকল উপজেলা হাসপাতালগুলোতে বিতরণ করার জন্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট সিভিল সার্জন অফিস ইনডেন্ট নং-৩, অনুযায়ী এমএসআর মালামালগুলো সংগ্রহের জন্য সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইনডেন্ট প্রদান করা হয়। তৎকালীন নতুন সিভিল সার্জন উৎপল কুমার দেবনাথ সাতক্ষীরায় যোগদানের পর উক্ত মালামাল সংক্রান্ত ব্যাপারে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ ৫৬৮ নং স্মারকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসাপাতালগুলোতে তদন্ত কমিটি খোঁজ নিয়ে দেখেন, এ মালামালগুলো কোথাও সরবরাহ না করে স্টোর কিপার ফজলুল হক ও তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ সালেহ আহমেদ সেগুলো আত্মসাৎ করেছেন। তারা অভিযোগ করেন স্টোর কিপার ফজলুল হক স্টক রেজিস্ট্রারসহ অন্যান্য তথ্যাদি গোপন করে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৫ টাকার মধ্যে ৭ কোটি ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৫ টাকার মালামাল সামগ্রী আত্মসাৎ করেছেন। দুদক’র সমন্বিত জেলা কার্যালয় খুলনার সহকারী পরিচালক মহাতাব উদ্দিন বাদী হয়ে উপরোক্ত ধারায় স্টোর কিপার ফজলুল হক ও তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ সালেহ আহমেদের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। অতঃপর স্টোর কিপার ফজলুল হককে গ্রেফতার করা হয়। সূত্র আরো জানায়, ফজলুল হক হাইকোর্ট থেকে বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করে পুনরায় সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে ২০১৭ সালে যোগদান করেন। যোগদান করে পুনরায় মেতে উঠেন দুর্নীতিতে। সরেজমিনে খোজ নিয়ে নিয়ে জানা যায়, শহরের মধুমল্লার ডাঙ্গিতে তিনি ৫ কাঁঠা জমির উপর আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। যার মালিক তার স্ত্রী। পাশে ৮ কাটা জমির উপর আরো একটি বাড়ি আছে। পারিবারিক অন্য কোন আয়ের পথ না থাকলেও চাকরির উপর ভর করে কিনেছেন ট্রাক, মাইক্রো, গড়ে তুলেছেন পারিবারিক সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ব্যালেন্স। সব মিলিয়ে তিনি ও তার পরিবার কোটি কোটি টাকার মালিক। ২০১৬ সালে দুদক তার সম্পদের বিষয়ে খোজ খবর নিতে শুরু করলে এ তথ্যগুলো বেরিয়ে আছে। এ ছাড়াও নামে-বেনামে তিনি আরো সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন বলে স্থানীয়রা জানান। অন্যদিকে অফিসের হিসাবরক্ষক আনোয়ার হোসেনের সম্পত্তির বিষয়ে খোজ খবর নেওয়া হচেছ। জেলার সচেতনমহল পুরো ঘটনার জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়েছেন।