দেশের খবর: আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়া এক জঙ্গি ঢাকায় আসার পর তাকে গ্রেফতার করেছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশানাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। সিরিয়া ফেরত ওই জঙ্গির নাম মুতাজ আব্দুল মজিদ কফিল উদ্দিন বেপারি ওরফে মুতাজ (৩৩)। সৌদি আরব থেকে সে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়ে গিয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গত রবিবার (৫ মে) বিকেলে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সোমবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সিটিটিসির উপ কমিশনার (ডিসি) মহিবুল ইসলাম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ‘সৌদি আরব থেকে এক বাংলাদেশি সিরিয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে সে ঢাকায় আসার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ যোগাযোগ করা হলে ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা শওকত আকবর বলেন, ‘মহানগর হাকিম ইয়াসমীনের আদালতে মুতাজকে সোপর্দ করে দশ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল। আদালত শুনানি শেষে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। মুতাজ নামে ওই ব্যক্তি সৌদি আরব থেকে আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে সিরিয়া গিয়েছিল।’
উত্তরা পশ্চিম থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা এসআই আব্দুল্লাহ ইবনে সাইয়ীদ সোমবার রাতে জানান, ‘সন্ত্রাসী বিরোধী আইনে দায়ের হওয়া ওই মামলায় মুতাজ ছাড়াও অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এসআই আশরাফুল হক বাবু বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছেন। এজাহারে মুতাজের সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করা এবং ঢাকায় এসে সরকার উৎখাতসহ নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।’
ঢাকায় সিরিয়া ফেরত আইএস জঙ্গি গ্রেফতারের খবরটি এমন দিনে এলো যার মাত্র পনের দিন আগেই প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় জঙ্গিদের সিরিজ বোমা হামলায় ৪০ জন শিশুসহ আড়াই শতাধিক মানুষ মারা গেছে। নিহতদের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় এক শিশুও রয়েছে। জায়ান চৌধুরী নামে ওই শিশুর লাশ বুধবারই দেশে ফিরিয়ে এনে দাফন করা হয়েছে। জায়ান বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি।
শ্রীলঙ্কার ভয়াবহ ওই জঙ্গি হামলাতেও যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই আইএসের হয়ে ইরাক ও সিরিয়াতে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। আইএসের পতন শুরু হলে তারাও নামে-বেনামে নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায় ফিরে যায়। এই হামলার পর থেকে বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক, যারা ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তারাও দেশে ফিরে নাশকতা করতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি ২২ জন নাগরিককে হত্যা করা হয়। তামিমও ২০১৩ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আসার আগে কানাডা থেকে বিভিন্ন সময়ে ইরাক-সিরিয়ায় গিয়েছিল।
এছাড়া ২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদান নামে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে ঢাকায় আইএস-এর জন্য সদস্য সংগ্রহ করছিল বলে সেসময় জানিয়েছিল পুলিশ। সিরিয়ায় গিয়ে আল-নুসরা ফ্রন্টের হয়ে যুদ্ধ করা সামিউন ঢাকার উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ দল তাকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে। সামিউন ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক হয়ে ঢাকায় প্রবেশ এসেছিল।
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ইরাক-সিরিয়ায় যারা আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল সেসব বাংলাদেশি এফটিএফ বা ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটারদের বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারা যাতে দেশে ফিরতে না পারে এজন্য তাদের বিষয়ে ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টগুলোতে তালিকা দেওয়া হয়েছে। তারপরেও কেউ যদি দেশে ফেরার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রবিবার (৫ মে) আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়া সিরিয়া ফেরত মুতাজ নামে যে জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সে চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক থেকে বাংলাদেশে আসে। দেশে ঢুকে সে বাংলাদেশ সরকার উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাশকতার পরিকল্পনা কররে আসছিল। রোববার নব্য জেএমবির ৫-৬ জন সদস্যের সঙ্গে উত্তরায় একটি গোপন বৈঠকে অংশ নেয়। সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হয় তাকে। তবে অভিযানের সময় তার সহযোগীরা সবাই পালিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে অভিযান পরিচালনকারী কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা।
সিরিয়া ফেরত জঙ্গি গ্রেফতারের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসী বিরোধী আইনে একটি মামলা (নং ৭) দায়ের হয়। দায়ের হওয়া মামলার এজাহার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে একটি পাসপোর্ট (বিই-০০৪৯৬৯৬), সৌদি আরবের একটি আইডি কার্ড, সৌদি আরবের ড্রাইভিং লাইসেন্স, একটি আইফোন, ‘কাফিরের জন্য রক্ত আপনার জন্য লাল’ শিরোনামে আইএসের ম্যাগাজিন রুমিয়াহ’র চারপাতার একটি রচনার বাংলা অনুবাদ, ‘খিলাফত ঘোষণা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের ছয় পাতার একটি আর্টিকেল, ৫০ পাতার আররিতে লেখা নথিপত্র এবং স্ম্যাসিং বর্ডারস ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ফর্ম সিরিয়া রেভুলেশন ২০১১ থেকে ২০২০ লেখা এক শ’ সাত পাতার একটি বই উদ্ধার করা হয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত মুতাজ বাংলা বলতে পারে না। সে ইংরেজি ও আররিতে কথা বলে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে নব্য জেএমবির ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে স্বীকার করেছে। সে নব্য জেএমবির কয়েকজন সদস্যদের সঙ্গে উত্তরা এলাকায় বৈঠক করছিল। তারা নব্য জেএমবির মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও নানারকম নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলেও স্বীকার করেছে।
এর আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান ওরফে আবু আব্দুল্লাহ নামে সিরিয়া ফেরত এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছিল বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান- র্যাব। সন্ত্রাসীবিরোধী আইনে সেই গাজী সোহান এখনও কারাগারে আটক রয়েছে। গাজী সোহান ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল। ২০১৫ সালের মে মাসে দেশে ফিরে আসার পর গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন করে গ্রেফতার হওয়া মুতাজ বংশানুক্রমে বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। সৌদিতে সে তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করতো। তার বাবা আব্দুর মজিদ বেপারি বাংলাদেশি হলেও মা হালিমা পাকিস্তানের নাগরিক। মুতাজ ২০১৪ সালে সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে সে ২০১৬ সালে সৌদি আরব থেকে তুরস্ক যায়। তুরস্কে থাকাকালীন সময়ে সে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওই সংগঠনের বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কিন্তু সেসময় সিরিয়ায় ঢুকতে না পেরে আবারও সৌদিআরবে ফিরে যায়। পরবর্তীতে সে ২০১৭ সালে মিশর ও তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেবারও ব্যর্থ হয়ে সৌদি আরবে ফিরে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের মে মাসে নিষিদ্ধ সংগঠন আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, গত বছরের শেষ দিকে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের পতন শুরু হলে অন্যদের মতো সেও পালিয়ে আবার তুরস্কে ফিরে আসে। প্রথমে সে সেখান থেকে সে গ্রিস হয়ে অন্য কোনও ইউরোপীয় দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীবিরোধী অভিযান জোরদার করলে ইউরোপে না গিয়ে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
সিটিটিসি’র সহকারী কমিশনার (এসি) ওয়াহিদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমরা তাকে রিমান্ডে এনেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানানো হবে।’
২০১৪ সালের ৩০ জুন ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গি সংগঠন আইএস খিলাফত ঘোষণা করলে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ সেখানে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। যাদেরকে ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার বা এফটিএফ বলা হয়। সেসময় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাক ও সিরিয়াতে যায়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে এমন অন্তত ৪০ জনের একটি তালিকা রয়েছে। যাদের অনেকেই অবশ্য বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। বাকিরা সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি অবস্থায় আছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে ঢাকায় আসা মুতাজের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এরপর থেকেই তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলতে থাকে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন প্রযুক্তির মাধ্যমে ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।