খোলা মত

“এ প্লাস পেয়েছি অথচ আব্বু কথা বলছে না”- দেবাশিস মণ্ডল

By Daily Satkhira

May 09, 2019

গত ৬ মে (সোমাবার) এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পাসের হার ৮২.০২%। এ প্লাস এর সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজারের একটু বেশি। যারা পাস করেছে এবং এ প্লাস পেয়েছে তাদেরকে অভিনন্দন। এবং যারা পাস করতে পারিনি অথবা কাক্সিক্ষত ফলাফল করতে পারিনি তাদের জন্য শুভ কামনা। যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও এ প্লাস পাওয়ার অসুস্থ’ প্রতিযোগিতা আমাদের চোখ এড়াতে পারিনি। দুটো বাস্তব ঘটনা বলি।

নাম নিধি (ছদ্মনাম)। সে সাতক্ষীরা শহরের নামকরা একটি স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এ প্লাস পেয়েছে। পরীক্ষার পূর্বের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে এবং স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় তার অর্জিত ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তার এ প্লাস পাওয়ার মত প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। যাইহোক, সে শেষের দিনগুলো খুবই পরিশ্রম করে এ প্লাস পেয়েছে। ২টি বিষয়ে এ গ্রেড হয়ে যাওয়ায় তার গোল্ডেন এ প্লাস হয় নি (যদিও গোল্ডেন এ প্লাস বলে অফিসিয়ালি কোন ফলাফল নেই। সবই এ প্লাস।)। ফলাফল প্রকাশের পর সে যখন তার ফলাফল আমাকে জানাচ্ছে না, স্বাভাবিক ভাবেই আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ ফলাফল প্রকাশের পর আমরা আত্মহত্যার মত হতাশাজনক খবর শুনতে পাই। আর সবচেয়ে বড় কথা সে আমার স্টুডেন্ট। যদিও আমি তার মাত্র একটি বিষয়ের শিক্ষক। যাইহোক, রাতে আমিই তাকে ফোন করলাম। বললাম নিধি তোমার ফলাফলের অবস্থা কী। সে বলল, স্যার, আমি এ প্লাস পেয়েছি। খুশি হয়ে আমি তাকে অভিনন্দন জানালাম। সাথে এটাও বললাম, তোমার এত ভাল রেজাল্ট অথচ তুমি আমাকে জানাওনি কেন? সে বলল, স্যার, আব্বু আমাকে খুব বকাবকি করেছে। সকাল থেকে এখনও আমার সাথে কথা বলেনি। তাই খুব খারাপ লাগছিল। কেন? সে বলল, স্যার, আমি গোল্ডেন এ প্লাস পাইনি তাই আব্বু আমাকে খুব বকাবকি করেছে। স্যার, আপনি একটু আব্বুকে বোঝান না প্লিজ। তাকে বলার মত আর কিছুউ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুধু সান্ত¦নার বাণী শুনিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। উল্লেখ্য যে, তার বাবাও একজন শিক্ষক।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হল: নাম রাফিত (ছদ্মনাম)। সেও সাতক্ষীরা শহরের আর একটি নামকরা একটি স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েও সে তার অভিভাবকের চিন্তা দূর করতে পারিনি। তার অভিভাবকের আপসোস তার ছেলে কেন জেলার মেধাক্রমে প্রথম হতে পারিনি। এখন ১ম ঘটনার অভিভাবকের কাছে আমার প্রশ্ন- সে নিজেও একজন শিক্ষক। তার জানার কথা সবাই এ প্লাস পাবে না। সবাই যদি এ প্লাস পেত তাহলে এ প্লাস বলে একটাই গ্রেড থাকত অন্য কোন গ্রেডের প্রচলন থাকত না। আর সবাই পাস করে না। তাহলে ফেল বলে কিছু থাকত না। পরীক্ষা নিয়ে মেধা যাচাই করার প্রয়োজন পড়ত না (যদিও যারা ফেল করে তারাই জানে ফেল করাটা কতটা কষ্টের। যাইহোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ)। তার চেয়ে বড় কথা তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের কতজনকে এ প্লাস পাওয়াতে পেরেছেন? উল্লেখ্য যে, তার নিজের প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই এ প্লাস পায়নি (যদিও এ প্লাস পাওয়াটাকে আমি শিক্ষার মানদ- হিসেবে দাঁড় করাচ্ছি না। আমি তার কথার প্রেক্ষিতে কথাটা বলেছি মাত্র)। অন্য কেউ না জানলেও অন্তত একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তার অজানা নয় যে এ প্লাস পাওয়া মানেই সব কিছু না। ছাত্রজীবনে তিনি কেমন রেজাল্ট করেছেন সেটা আমি জানি না। আমাদের মনে রাখা দরকার, এ প্লাস না পেয়েও অনেক কিছুই করা যায়, এমনকি বিশ্বকেও জয় করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এ প্লাস তো দূরের কথা, স্কুলেই যেতেন না (তখন অবশ্যই ডিভিশন পদ্ধতি ছিল। তখনকার হিসেবে র্ফাস্ট ক্লাস অথবা বোর্ড স্ট্যান্ড শব্দদ্বয় ব্যবহার করা ভাল)। তাহলে কি আমরা ভাবব তারা আমাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অর্জিত এই এ প্লাসধারীদের থেকে কম মেধাবী? অবশ্যই না। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট টিমের অনেক খেলোয়ার যারা বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে কতজন আছে যারা এই তথাকথিত এ প্লাস পেয়েছেন? বড় বড় বিজ্ঞানী, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সবাই কি এ প্লাসধারী? অবশ্যই না। এদের মধ্যে প্রচুর লোক আছেন যারা থার্ড ক্লাস পেয়েছেন। কিন্তু তারা কি তাদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারছেন না? অবশ্যই পারছেন এবং ভবিষ্যতে পারবেনও। কারণ তারা সুশিক্ষিত।

আর দুটি ঘটনাবলি। সাজিদ আক্তার। ২০১৬ সালে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৫০ পেয়েছিল এবং আসিফ-ই-এলাহি ২০১৭ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৫৬ পেয়েছিল। উভয়ই এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়েছিল। এসএসসিতে এপ্লাস পেয়ে এইচএসসিতে এ প্লাস না পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে তাদের অভিভাবক এবং আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক সমালোচিত হতে হয়েছিল। এবং এটার মাত্রা মানসিক নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল। কিন্তু তারা কারোর কথার কোন কর্ণপাত করে নি। তাদের মনে ইচ্ছে ছিল এইচএসসি পাসের পর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে লেখাপড়া করতে। উচ্চমাধ্যমিক ভর্তির পর থেকেই তারা নিজেদেরকে ঠিক সেভাবেই প্রস্তুত করছিল। এর ফলে তাদের একাডেমিক ফলাফল হয়ত একটুখানি প্রভাবিত হয়েছে (যদিও সেটাকে আমি খারাপ মনে করিনা) কিন্তু তারা তাদের জানার পরিধিকে সমৃদ্ধি করেছে। যাইহোক, সময়মতো অন্যান্য এ প্লাসধারীদের সাথে তারাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিল। বাস্তবতা হল, এই দুই জনই ঐ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি) পিওর ম্যাথমেটিকস্-এ পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। তথাকথিত এ প্লাসধারী আর কেউ-ই চান্স পায়নি। এমন বাস্তবতায় আমাদের দেশের অসুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন অভিভাবকদের কাছে আমার প্রশ্ন- ঐ দুই শিক্ষর্থী যারা ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি খরচে পড়ার সুযোগ পেয়েছে তারা কি আমাদের এই এ প্লাসধারীদের চেয়ে কম মেধাবী? যদি না হয়ে থাকে তাহলে এ প্লাস অথবা গোল্ডেন এ প্লাস না পাওয়ার কারণে আপনারা কেন আপনাদের সন্তানদেরকে এভাবে মানসিকভাবে নির্যাতন করছেন? কারণ আমাদের মনে রাখা দরকার, জীবনের সফলতা ঐ ৫ মিনিটের খাতা মুল্যায়নের উপরে নির্ভর করে না। সফলতা নির্ভর করে পরিশ্রম, সততা ও আন্তরিকতার উপরে। কারণ এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে তারা বিষয়টি জানে, কিন্তু কোন একটা কারণে পরীক্ষার খাতায় বিষয়টি ভুল করে ফেলেছে। অথবা সৃষ্টিকর্তা না করুন অসুস্থতার কারণে পরীক্ষাটা ভাল হয়নি। আবার এমনটাও হতে পারে পরীক্ষক তাড়াহুড়ো করে খাতা দেখতে গিয়ে ভুল মার্কিং করে ফেলেছেন বা নম্বর কম হয়ে গেছে। আর এর ফলে রেজাল্টটি আশানুরূপ হয়নি। তাই বলে এটা তাদের অযোগ্যতা নয়। অনেকেই আছেন যারা থার্ড ক্লাস পেয়েও জীবনে এমন কিছু করেছেন বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছেলেটাও তার ধারে কাছে যেতে পারিনি। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। যারা এ প্লাস না পাওয়ার কারণে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু তারাই বিদেশে গিয়ে বড় বড় নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন; এমনকি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনামের সাথে শিক্ষকতাও করছেন। যার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ জনাব ড. সাজিদ আলী হাওলাদার যাকে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী বলা হয় এবং যার অধীনে বিশ্বের নামকরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পিএইচডি করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আরও স্পষ্ট করে বললে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করে ‘অযোগ্য’ (!) হিসেবে বিবেচিত হন। এইতো আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা! সাম্প্রতিক এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং করা হয় যেখানে বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। একবার ভেবে দেখুনতো দেশে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে একটি মহাদেশভিত্তিক ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং তালিকায় যখন নিজের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে হয়, সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার খাতা মূল্যায়ণ পদ্ধতিটা কেমন হতে পারে। আর তার জন্য এ প্লাস পায়নি বলে অথবা এ প্লাস পেয়েছে কিন্তু গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি বলে আপনার সন্তানকে আপনি বকাবকি করতে পারেন না। তার সাথে কথা বন্ধ করতে পারেন না। এক অভিভাকতো তার ছেলেকে বলেই বসলেন, সে (তার ছেলে) এ প্লাস পায়নি বলে তিনি আর তার (ছেলের) পড়ালেখার খরচ দিবেন না। এমনকি তাকে জুতাপেটা করতে চেয়েছেন। আশ্চার্য ব্যাপার! এটা কেমন মানসিকতা! এটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের চিন্তা হতে পারে না। আর এসব কারণে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আমরা এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অহরহ আত্মহত্যার খবর শুনতে পাই যা খুবই দুঃখজনক এবং এটা সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতির জন্য হতাশাব্যঞ্জক। কাক্সিক্ষত ফলাফল না করতে পারায় তাদেরকে যেভাবে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে তাতে করে তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা পোষণ করছে। ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ কেউ বিপদগামী হচ্ছে, ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে, এমনকি মাদক সেবনের মত ভয়ংকর খবর পাওয়া যাচ্ছে। কারণ কোমলমতি এইসব শিক্ষার্থীরা ভাবে তাদের বোধ হয় কেউ ভালোবাসে না, কেউ তাদের কথা চিন্তা করে না। এ সবকিছুর জন্য দ্বায়ী আমরাই-হ্যাঁ, আমরাই। আমাদের এই অসুস্থ মানসিকতা, আমাদের এই জীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের এই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা। তার চেয়ে বেশি দ্বায়ী-পাশের বাড়ির আন্টিরা। কারণ তাদের সেই তাচ্ছিল্য ভরা ভাষা- ভাবি, আপনার ছেলে/মেয়ে কি এ প্লাস পেয়েছে?-এটা আমরা সবাই হজম করতে পারি না। আরও বেশি কষ্ট হয় যখন শোনা যায়, হাজার হাজার এ প্লাসধারীর মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দুইজন পাস করে। যখন শোনা যায়, ফোর ফার্স্ট ক্লাস অথবা চারটিতে এ প্লাস (এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স) পেয়েও কোনো চাকরি পায়নি। বেকার। তখন কী হবে ঐ এ প্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস দিয়ে! এই আমরাইতো বলি যে, ও এ প্লাস/ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেতো কী হয়েছে, ওতো বেকার। ছেলেমেয়ে বড় হলে বিয়ে দেওয়ার সময় অথবা কারোর সামাজিক অবস্থান বা মর্যাদা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু এ প্লাস/ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটাকে মূল্যায়ন করি না। আমরা তখন তার চাকরি বা আয়ের উৎসটাকে বিবেচনায় নিয়ে আসি। আমরা কিন্তু এ প্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া কাউকে বলিনা যে, ও চাকরি করে না তাতে কী হয়েছে, ও কিন্তু মেধাবী; ও কিন্তু এ প্লাস পেয়েছে। তখন কিন্তু এ প্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার কোন মূল্য থাকে না। তখন আমরা মূল্যায়ন করি তার চাকরি, তার আয়ের পরিমান, সমাজে তার প্রভাব ইত্যাদি। এমনকি কেউ ঘুষ-দুর্নীতি করে বিশাল অর্থ-সম্পদের মালিক হলেও আমরা সেটাকে নিয়ে কখনও কখনও গর্ব করতেও কার্পণ্য করি না।। তাহলে আমাদের এই শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছ থেকে কী বার্তা পাচ্ছে? ছাত্র জীবনে তাদেরকে শেখানো হচ্ছে- এ প্লাস না পেলে সবই বৃথা; আবার তারা বড় হলে এই আমরাই বলছি- চাকরি না পেলে সবই বৃথা। তারা কোনটা গ্রহণ করবে? আর এই চাকরি পেতে গেলে বা ভাল আয় করতে হলে বা প্রভাবশালী হতে হলে অথবা জীবনে সফল হতে হলে, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে কিছু দিতে হলে এ প্লাস বা ফার্স্ট ক্লাস না পেলেও চলে। কিন্তু পরিশ্রম না করলে, জ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত না করলে চলে না। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, A lamp can never light another lamp unless it continues to burn its own flame.. অর্থাৎ একটি প্রদীপ নিজের শিখা না জ্বালিয়ে কখনও অন্য প্রদীপকে আলোকিত করতে পারে না। ঠিক একইভাবে আমরা সূর্যের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, সে নিজে জ্বলে-পুঁড়ে ছারখার হয়ে কিন্তু পৃথিবীকে আলোকিত করে। ঠিক আমাদেরকেও আগে নিজে জ্বলতে হবে, তারপর ঐ আগুনের লেলিহান শিখা দিয়ে অন্যকে আলোকিত করতে হবে। একটা বিষয় আমাদের ভালভাবে মনে রাখা দরকার, যোগ্য ব্যক্তি কখনও বসে থাকে না। সে কোনো না কোনো কিছু করে। পরিশ্রম আজ পর্যন্ত কখনও বৃথা যায়নি-যায় না-আর যাবেও না। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, যারা পরিশ্রম না করে সংক্ষিপ্ত উপায়ে সফল হতে চায় তারাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কারণ, সফলতার কোনো সংক্ষিপ্ত উপায় নেই। পৃথিবীতে যারা সফল হয়েছেন তারা পরিশ্রম না করে কোনো সংক্ষিপ্ত উপায়ে সফল হননি। সুতরাং কাঙ্খিত ফলাফল করতে পারোনিতো কী হয়েছে? এবার হয়নি পরেরটায় হবে। তাইবলে তুমি ব্যর্থ হওনি। আমাদের অজানা নয়, জীবনে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। সে হয় জিতবে, না হয় শিখবে। সুতরাং ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেই মোতাবেক কাজ করতে হবে। তাহলেই সফলতা আসবে। পাখি যেমন উন্মুক্ত আকাশে তার ডানার উপর ভর করে উড়তে থাকে, ঐ দুটি ডানাই কিন্তু তার ভরসা। ঠিক একইভাবে আমদেরকেও স্বপ্নের উপরে ভর করে জীবন আকাশে উড়তে হবে। ডানা না থাকলে পাখি যেমন উড়তে পারে না; স্বপ্ন না থাকলে ঠিক আমরাও বাঁচতে পারি না। সুতরাং সাময়িক কষ্ট পেয়ে হতাশ হলে চলবে না। একটি প্রবাদ আছে, মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আঁড়ালে তার সূর্য হাসে। সুদূর আকাশে মেঘ যেমন দীর্ঘক্ষণ থাকে না, জীবনের আকাশেও দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাÑএগুলো চিরদিন থাকে না। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী না; এমনকি দুঃখ-কষ্টগুলোও।

যাইহোক, সময় এসেছে এগুলো নিয়ে ভাববার; সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা করার, সময় এসেছে পরিবর্তনের। আর এখনই যদি আমরা এ বিষয়ে সচেতন না হই তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনোই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। তবে এতটুকু বলা যায়, এ প্লাসধারীর অভাব থাকবে না। কিন্তু এত এত এ প্লাস নিয়ে আমরা করবটা কী যদি যোগ্য জাতি তৈরি করতে না পারি? এ ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন দেখা যাবে, আমরা লক্ষ লক্ষ এ প্লাসধারী উৎপাদন করতে পারছি, পারছি এমন জনবল তৈরি করতে যারা ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার যোগ্য কিন্তু কোন সংস্কৃতিমনা সুস্থ’ মানসিকতাসম্পন্ন সুশিক্ষিত জাতি তৈরি করতে পারছি না। কিন্তু এটি আমাদের কাম্য নয়।