হাসান হাদী : মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত কাজে কয়েকজন সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) সহযোগিতা করছেন না। এ নিয়ে দফায় দফায় অভিযোগ করেছে তদন্ত সংস্থা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল(আইসিটি)’র তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক মন্ত্রিপরিষদকে ডিসিদের অসহযোগিতার কথা বারবার অবগত করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত কাজে সহযোগিতার জন্য ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
যেসকল জেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চলছে বা মামলা চলমান সেকল জেলার ডিসিদের সভাপতি করে একটি করে সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাতক্ষীরার ৪ জন শীর্ষ মানবতাবিরোধীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে আইসিটি’র তদন্ত সংস্থা। বারবার তাগাদা দেয়া সত্বেও এই জেলায় সাক্ষী সুরক্ষা কমিটির কোন মিটিংও অনুষ্ঠিত হয়নি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা কারাগারে অন্তরীণ জামাত-শিবিরের একটি অংশ তাদের আত্মগোপনে থাকা ক্যাডারদের সহযোগিতায় জেলা জামাতের আমির মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডলের মামলার সাক্ষীদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের হত্যা পর্যন্ত করতে পারে বলে আশংকা করে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারকে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে গত ডিসেম্বর মাসে। চিঠিটির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের মহাপরিচালক, র্যাবের ডিজি এবং সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসককেও প্রদান করা হয়।
এ বিষয়ের অগ্রগতি জানতে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, চিঠি পাওয়ার পর সদর থানাকে বিষয়টি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চিঠির একটি কপি সদর সার্কেল অফিসকেও ফরওয়ার্ড করা হয়েছে।
এদিকে যাদেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হতে পারে বলে তদন্ত সংস্থা আশংকা করা হয়েছে তারা এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশের ভূমিকায় অসন্তোয় জানিয়ে বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, পুলিশ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগই করেনি। পুলিশের নির্লিপ্ততার তারা হতাশা ব্যক্ত করেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয় সভায় জানানো হয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিত করা, ঘর-বাড়ি লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত কাজে সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক বারবার তাগিদ দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং মাঠ প্রশাসনকে। তাগাদা সত্ত্বেও অনেক জেলা প্রশাসক এখনও এ সম্পর্কিত তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠায়নি। এ জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত কাজে সহায়তা প্রদানের জন্য বিভাগীয় কমিশনাররা সহায়তা প্রদান করবেন।’ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সকল বিভাগীয় কমিশনার এই সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট থাকার কথা জানিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং ডিসিদের সহযোগিতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জিয়াদ-আল-মালুম বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সহযোগিতা পাই না। জেলা প্রশাসকদের চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সহযোগিতাই বেশি প্রয়োজন হয়। অনেকেই সহযোগিতা করেন না। কেউ কেউ অসহযোগিতাও করেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত সংস্থার অপর এক সদস্য জানান, ‘অনেক সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সহযোগিতা করেন না। কারণ তারা নিজেরাই জামায়াতের লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রাখেন। তাহলে সহযোগিতা পাবো কিভাবে? সাতক্ষীরায় সহযোগিতা তো পাইনি। উল্টো অসহযোগিতা পাওয়া গেছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কারও কারও কাছ থেকে।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার মো. নূর-উর-রহমান বলেন, ‘তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সহযোগিতা দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধিদল আসলে বিশেষ নিরাপত্তাসহ নিরাপদে থাকা এবং নিরাপদে চলার জন্য গাড়ির ব্যবস্থাসহ আনুসঙ্গিক সহযোগিতা করছি। এ বিষয়ে ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বর্তমানে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী জেলাসহ বেশ কিছু জেলায় তদন্ত সংস্থা মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে নেমেছে।
সাতক্ষীরা জেলার ৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল কারাগারে থাকলেও অপর তিন আসামি আব্দুল্লাহিল বাকী, খান রোকনুজ্জামান ও জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কা বর্তমানে পালিয়ে আছে। তাদের বিরুদ্ধে গত বুধবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ০১।