নিজস্ব প্রতিনিধি : ছয় মাস আগে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হিসাবে যোগদানকারি ডাঃ শেখ আবু শাহীনের সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন কর্মকাণ্ডে গড়ে প্রতি মাসে রাজস্ব আদায় বাড়ে আড়াই গুণ। চিকিৎসা সেবার মানউন্নয়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িতদের সকলের প্রতি সতর্কবার্তা জারি করায় পরিবর্তণ এসেছে সদর হাসপাতালের সার্বিক চিত্রের। জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি দালাল মুক্তকরণ, রোগীদের খাদ্য ও সেবার মান বৃদ্ধি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সরকারি সরবরাহ অনুযায়ি মালামাল রোগীদের জন্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান, সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা মূলক কর্মমাণ্ডের ফলে ডাঃ আবু শাহীন দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কাছে আতঙ্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মী জানান, ২০১৯ সালের ১১ জুলাই সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করেন তালা উপজেলার অভয়তলা গ্রামের ডাঃ শেখ আবু শাহীন। সদর হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে সময় কেটে গেছে প্রায় এক মাস। এরপর পরই বাড়তে শুরু করে হাসপাতালের রাজস্ব আদায়। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে হাসপাতালে বিভিন্ন খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয় ২২ লাখ ২৩ হাজার টাকা। পরবর্তী ছয় মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া আগে কেবিন ভাড়া হিসেবে মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আদায় হলেও বর্তমানে তা প্রতি মাসে গড়ে ৩৮ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে। আগে কোন প্রকার রসিদ ছাড়াই প্যাথালজি টেষ্ট ও সিটি স্কান করাতে বাধ্য হতো বর্হিবিভাগ ও অন্তঃ বিভাগের রোগীরা। এতে পরীক্ষা নিরীক্ষা বাবদ অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগের পাশাপাশি রোগীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতেন। ডাঃ শেখ আবু শাহীনের যোগদানের এক মাস না যেতেই রসিদের মাধ্যমে নিধারিত সরকারি ফি নিয়ে ওইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। আবার সেটা ঠিক ঠাক হচ্ছে কিনা তা দেখতে মনিটরিং জোরদার করা হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, সাতক্ষীরা শহরে যে সমস্ত বেসরকারি ক্লিনিক বা নার্সিংহোম রয়েছে তার অনেকটিতেই লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স থাকলেও ওটি, নার্স ও জনবল যথেষ্ট ছিল না। ইতিপূর্বে কর্মরত থাকা সিভিল সার্জনদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে বা রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে প্রভাব খাটিয়েই অনেক ক্লিনিক মালিকরা পার পেয়ে গেছেন। যদিও গত কয়েক মাসে সিভিল সার্জন আবু শাহীনের উদ্যোগে সাতক্ষীরা সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন কিèনিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগে মালিকদের দেওয়া হয়েছে জেল অথবা আদায় করা হয়েছে জরিমানা। ঔষধ কোম্পানীর রিপ্রেজেনটেটিভদের ভিজিটের জন্য সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর দু’ টো পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সপ্তাহের বাকী দিনগুলো তারা হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে পারতেন না। যে সমস্ত দালালরা (ক্লিনিকের কর্মচারি থেকে ভ্যানচালক) হাসপাতালের রোগী কৌশলে বের করে নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি করাতেন তাদের বড় অংশকেই গত ছয় মাসে এলাকা ছাড়া করা হয়। সদর হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা জেলা প্রশাসক ও রোড্স এণ্ড হাইওয়ে এর মাধ্যমে উচ্ছেদ করে সেখানে দৃষ্টিনন্দন গাছ লাগানো হয়েছে। হাসপাতালের সামনেই লাগানো হয়েছে ফুলের বাগান। বেসরকারিভাবে পাওয়া ৫০ হাজার গাছের পরিচর্যা ও হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন মালী কাম নৈশপ্রহরী। ৩৯তম বিসিএস এ পদায়নকৃত বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্য উপজেলা হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে সার্জারী, শিশু, এনেসথেসিয়া বিভাগে একজন, একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও একজন মেডিকেল অফিসারসহ ১০টি শাখায় ১০জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছনা বাড়ানোর পাশপাশি ডায়েরিয়া ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সার্জারী ওয়ার্ডে অপারেশন থিয়েটার চালু করা হয়েছে। ঠিকাদার পরিবেশিত খাবার যাঁচাই বাছাই করে মানসম্মত করার পর বিশেষ পোশাক পরে পরিবেশনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল এক্সরে প্লেট এর সংকট ঘোচাতে এমএসআর এর বরাদ্দ থেকে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সুসম অস্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। সদর হাসপাতালে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ না থাকলেও মেডিকেল কলেজ থেকে ডাঃ নাসিরউদ্দিনকে নিয়ে এসে কাজ করানো হচ্ছে। সেবার মানসিকতা বাড়ানোর জন্য মর্নিং মোটিভেশন সেমিনার করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার জন্য রিভার ওসমোসিস এর ব্যবস্থার পাশপাশি গভীর নলকুপ বসানো হয়েছে। আন্তঃবিভাগে যে সমস্ত রোগী মারা যায় সেসব মৃত্যুর পর্যালোচনার জন্য বিশেষ সভা করা হয়। বহিঃবিভাগকে আধুনিকীকরণ করে জরুরী পরিষেবা হিসেবে শ্বাসকষ্ট জনিত রোগীদের নেবুনাইজেসন, উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগীদের স্যালাইন, বিভিন্ন জরুরী ইনজেকশন দেওয়াসহ তাদের দেখাশুনায় আয়া নিয়োগ দিয়ে তারা যাতে অল্প সময়ে বাসায় ফিরে যেতে পারে সেজন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। এ ছাড়াও জরুরী বিভাগে খোলা হয়েছে মিনি ওপারেশন সেন্টার ও পৃথক পয়জনিং ওয়াশ রুম। হাসপাতালে সব ধরণের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। হাসপাতালের উন্নয়নে কোয়ালিটি ইমপ্র“ভমেন্ট কমিউনিটি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ডিজিটাল সাউণ্ড সিস্টেমের মাধ্যমে হাসপাতালের বিভিন্ন বিষয়ের স্বচ্ছতা আনা হয়েছে। বহিঃবিভাগে প্রবীন ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা কার্ড দেওয়া হচ্ছে। এজন্য ১১নং কক্ষে একজন করে ডাক্তার রাখা হয়েছে। শুন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্য সেবায় আইএমসিআই ও পুষ্টি সেল খোলা হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত রিসিপশন ডেক্স চালু রাখা হয়েছে। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার জন্য ৮নং ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় ৬নং কক্ষে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মাষ্টাররোলে এবং আউট সোর্সিং এ কর্মরত ১৬ জনকে কমিউনিটি সাপর্টিং থেকে মাসিক মোট ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। নার্সিং ইনস্টিটিউটে আর্থিক সুবিধা নিয়ে ভর্তির অনিয়ম দূর্ণীতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপে ভাল ছিলেন না হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির কতিপয় প্রভাবশালী ও সুবিধাভোগী সদস্য।
হাসপাতালের উন্নয়নে ডাঃ শেখ আবু শাহীন বলেন, স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পিট তৈরি করতে চান। কমিউনিটি সাপটিং ফাণ্ড থেকে এককালিন টাকা নিয়ে সেবা রিভলবিং ফাণ্ড তৈরি করে জরুরী ডিজিটাল ফিল্ম কেনা হবে। স্কানু আধুনিকীকরণ বা নবজাতকের পরিচর্যা কেন্দ্রটি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বাচাদের মা বা তাদের দেখাশুনাকারিদের জন্য ওয়েটিং রুম বানানো হবে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে পাওয়া গত ১২ জানুয়ারির পরিপত্র অনুযায়ি একজন রোগীর সঙ্গে দু’জন স্বজন ওয়ার্ডে ঢুকতে পারার নির্দেশনাটি যথাযথভাবে মানা হবে।
তবে ডাঃ শেখ আবু শাহীন ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে আগামি বৃহষ্পতিবার যশোরের সিভিল সার্জন হিসেবে যোগদান করতে যাচ্ছেন এমন খবরে অনিয়ম ও দূর্ণীতির সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচাি দের সাথে একটি বিশেষ মহলের মধ্যে খুশীর বাতাস বইছে। যারা ভাল কাজের জন্য সিভিল সার্জনকে সহযোগিতা করেছেন তাদেরকেও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তবে নতুন যোগদানকারি সিভিল সার্জন ঝিনাইদহ ম্যাটস এর সহকারি পরিচালক হুসাইন শওকত যোগ দিয়ে সদর হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে ডাঃ আবু শাহীনের দৃষ্টান্তকে অনুসরন করবেন এটাই সাতক্ষীরার সুশীল সমাজের মানুষ প্রত্যাশা করেন।
পূর্ববর্তী পোস্ট