দেশের খবর : বিভিন্ন মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রভাব খাটিয়ে ‘স্বামী’ আরিফুল চৌধুরীর জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা তথা জেকেজি হেলথকেয়ারকে সরকারি কাজ পাইয়ে দিতেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। ফলশ্রুতিতে করোনার এ দুর্যোগকালে জেকেজি হেলথকেয়ার প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।
শুক্রবার (১৭ জুলাই) সাবরিনাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ডিবি পুলিশ। এ সময় তেজগাঁও থানায় করা প্রতারণার মামলাটি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে আবারও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। আদালত শুনানি শেষে দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসব কথা উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘তিনদিনের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সাবরিনাকে দফায় দফায় মামলার বিষয়ে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি মামলা সংক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যা যাচাই-বাছাই চলছে। সাবরিনা তার সহযোগীদের (যাদের অনেকে আসামি) নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের পজিটিভ ও নেগেটিভের জাল রিপোর্ট সরবরাহ করেছিলেন। নিরীহ লোকদের টাকা আত্মসাৎ এবং অবহেলার মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বিস্তারে সহায়তা করে আসছে সাবরিনা। সাবরিনা স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন সূত্রে প্রভাব খাটিয়ে স্বামী আরিফুল চৌধুরীর জেকেজি হেলথ কেয়ারকে বিভিন্ন সরকারি কাজের আদেশ পাইয়ে দিতেন। ফলশ্রুতিতে জেকেজি হেলথ কেয়ার বেপরোয়াভাবে সমাজে এ ক্ষতিসাধন করে এবং বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বলে সাক্ষ্য প্রমাণে পাওয়া যায়।’
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে আসামির সহযোগী অন্যান্য পলাতক আসামিদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ, গ্রেফতার, আলামত উদ্ধার, এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোন ব্যক্তি এই ঘটনায় জড়িত তা উদঘাটনে আসামিকে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।’
ফের রিমান্ডে সাবরিনা :
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গত ১২ জুলাই গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রথমে তাকে তেজগাঁও থানা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকলেও সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ১৩ জুলাই তার তিন দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেন আদালত। তবে মামলার সুষ্ঠু তদন্তে আরও জিজ্ঞাসাবাদের স্বার্থে ডা. সাবরিনা চৌধুরীর আরও ৫ দিনের রিমান্ড চান তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তবে শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমান দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। অপরদিকে, আসামি পক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন।
পাপের বোঝা পরস্পরের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা স্বামী-স্ত্রীর :
গত ২৩ জুন সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। ২৪ জুন আরিফ চৌধুরী ও সহযোগী সাঈদ চৌধুরীর দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তবে বুধবার (১৫ জুলাই) আরিফুলের ফের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) রিমান্ডে মুখোমুখি হন আরিফ-সাবরিনা। স্বামীর সামনে সাবরিনা বলেন, ‘আরিফের জন্যই আজ এই অবস্থা’।
সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা দাবি করেন, জেকেজি ও ওভাল গ্রুপের অনেকেই এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত। আরিফ চৌধুরীর এই কর্মকাণ্ড এবং ব্যক্তিগত হয়রানির কারণে তিনি তাকে ডিভোর্সও দিয়েছেন। তবে আরিফের দাবি, সাবরিনার কারণে এই অপকর্মে জড়িয়েছেন তিনি।
যেভাবে সামনে এলো ডা. সাবরিনার নাম :
২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে আটক করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে হিরু তাদের জানায়- হিরু ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করতেন। তিনি স্বীকার করেছেন, কোর্টেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন যে করোনার ভুয়া রিপোর্টের সঙ্গে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত।
এরপর জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ। গ্রেফতার সিইওকে পুলিশকে জানায়, এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী।
কে এই সাবরিনা :
ডা. সাবরিনা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। পুলিশ বলছে, সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান। তবে সাবরিনা নিজেকে জেকেজির ‘চেয়ারম্যান নয়’ বরং প্রতিষ্ঠানটির ‘কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক’ দাবি করেছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাবরিনা আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। আরিফের প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়েছে তার। চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথকেয়ার। প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা।
সূত্র আরও জানায়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল সাবরিনা-আরিফ দম্পতির জেকেজি প্রতিষ্ঠান। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেয়া ছিল। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেককে জেকেজির বুথের ঠিকানা দেয়া হতো। এভাবে কর্মীরা প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতো।
পরে তাদের গুলশানের একটি ভবনের ১৫ তলার অফিসের একটি ল্যাপটপ থেকে ভুয়া সনদ দিত। ওই ল্যাপটপ থেকে জেকেজির কর্মীরা রাতদিন শুধু জাল রিপোর্ট তৈরির কাজ করতে। প্রতিটা সনদের জন্য নেয়া হতো পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিদেশিদের কাছ থেকে নেয়া হতো ১০০ ডলার। যদিও শর্ত ছিল বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত ল্যাবে পাঠাতে হবে। কিন্তু তারা সব ধরনের শর্তভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দিত।
এদিকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ডা. সাবরিনাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোববার (১২ জুলাই) মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।