স্বাস্থ্য সংবাদ : নাক দিয়ে শুধু একবার নিঃশ্বাস নেবেন। আর তাতেই আপনার টিকা নেওয়া হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই টিকা করোনাভাইরাসের সব ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেই প্রায় শতভাগ কার্যকর।
ওয়েবসাইটে নিবন্ধন, হাসপাতালে যাওয়া, বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে টিকা সংরক্ষণ, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে টিকা নেওয়া— এগুলো হতে পারে অতীত। আপনি টিকা নেবেন আপনার পছন্দ মতো সময়ে, নিজেরটা নিজেই।
একটি পাউডার টিকা সম্পর্কে এমনটিই বলা হয়েছে। বাংলাদেশ এই টিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে যাচ্ছে। সুইডেনের বিজ্ঞানীরা এমন একটি কার্যকর টিকা নিয়ে কাজ করছেন। টিকাটি মানুষের ওপর ট্রায়ালের অপেক্ষায় রয়েছে। সর্ব সাধারণের জন্য এটি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার আগে টিকাটির গবেষণা ও উন্নয়নের তৃতীয় এবং চূড়ান্ত ট্রায়াল হবে। যে ট্রায়াল আগামী মাসে বাংলাদেশে শুরু হবে।
সরকার যদি সহজভাবে গবেষণা ও অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়, আগামী বছরের শুরু থেকেই এই নাকে নেওয়ার টিকাটি ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য হবে।
ট্রায়াল সফল হলে বাংলাদেশ উৎপাদন মূল্যে টিকাটি কিনতে পারবে। এমনকি দেশেও এই টিকা উৎপাদন করতে পারবে। জাতির পিতার নাম অনুসারে টিকাটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু আইএসআর’ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সুইডিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোল্ডিং এবি (আইএসআর) তাদের উৎপাদিত টিকাটি বাংলাদেশে মানুষের ওপর ট্রায়ালের খুব কাছে রয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কয়েকজন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী, যারা সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বাস করছেন, তারা এই টিকা তৈরির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
মানুষের ওপর ট্রায়ালের জন্য আইএসআর এই মাসের শুরুর দিকে কন্ট্রাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) হিসেবে বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে।
সিআরও এর প্রধান তদন্তকারী প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এবং প্রফেসর ডা. আহমেদুল কবির। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই টিকার ট্রায়াল পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
প্রথম ধাপের ১৮০ জন সুস্থ মানুষের ওপর এই পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রফেসর আবদুল্লাহ জানান, করোনাভাইরাসের অন্যান্য দুই ডোজের টিকার মতোই এই টিকাটি প্রথমবার নাকের সামনে রেখে নিঃশ্বাস নেওয়ার পর তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বার একই কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ইঁদুরের ওপর পরিচালিত সুইডিশ এই টিকার ট্রায়ালের ফলাফল খুবই আশাব্যঞ্জক। কারণ এর কার্যকারিতার হার শতভাগের কাছাকাছি এবং টিকাটির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রধানমন্ত্রী টিকাটি সম্পর্কে সবকিছু জানেন। আমরা এর নাম বঙ্গবন্ধু আইএসআর রাখার প্রস্তাব দিয়েছি।’
প্রফেসর আহমেদুল কবির জানান, তারা ইতোমধ্যেই প্রটোকল প্রস্তুত করেছে এবং বাংলাদেশে ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদনের জন্য চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছে জমা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সদস্য সচিব প্রফেসর কবির জানান, যদি প্রথম ধাপের ট্রায়াল সফল হয় তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালও এদেশেই হবে।
তিনি বলেন, ‘ট্রায়ালের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বাংলাদেশ উৎপাদন খরচে টিকাটি কিনতে পারবে। এমনকি সরকার চাইলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এটি উৎপাদন করতে পারবে।’
আইএসআর এর বিজ্ঞানীদের মতে, শুকনো পাউডারের টিকাটি তৈরিতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রোটিন ব্যবহার করা হয় এবং এটি ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
তারা আরও জানান, টিকাটি উন্নয়নে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে— বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত কোভিডের যে টিকাগুলো আছে সেগুলোর তুলনায় এটি সংরক্ষণ করা খুব সহজ।
আইএসআর প্রতিষ্ঠাতা সুইডেনের অন্যতম প্রধান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের ইমিউনোলজির প্রফেসর ওলা উইনকুইস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে ২৬ জুলাই বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই টিকার গেমচেঞ্জিং অবস্থান হলো, এটি তাপানুকূল পরিবেশে না রেখেই খুব সহজে বিতরণ করা যাবে এবং স্বাস্থ্যকর্মী না থাকলেও এটি প্রয়োগ করা যাবে।’
আইএসআর এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওলা উইনকুইস্ট তাদের ওয়েবসাইটে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের শুরুতে প্রথম ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আমার সন্তোষজনক সাফল্যের জন্য বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করতে পেরে খুবই আনন্দিত।’
প্রফেসর কবির জানান, যদি তারা ক্লিনিকাল ট্রায়ালের অনুমতি পায়, স্থানীয় একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক আইএসআর-এর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ করবে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ টিকা তৈরি ও বিতরণের জন্য আইএসআর ৬ জুলাই ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে।
‘সমঝোতা স্মারকের উদ্দেশ্য হলো, একটি লাইসেন্সিং চুক্তির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতার জন্য সম্মত হওয়া। যা ইউনিমেডকে বাংলাদেশে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আইএসআর এর টিকা তৈরি ও বিতরণের একচেটিয়া অধিকার দেবে,’ আইএসআর তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনিমেড প্রতি বছর ১০০ মিলিয়ন ইউনিট টিকা উৎপাদন করবে। তাদের লক্ষ্য পাঁচ বছরের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন ইউনিট বা তার বেশি বার্ষিক উৎপাদন করা।
প্রফেসর কবীর জানান, যদি সবকিছু সুষ্ঠুভাবে হয় এবং বিএমআরসি দ্রুত অনুমোদন দেয়, তাহলে প্রথম ধাপের ট্রায়াল নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু করা যাবে।
প্রফেসর কবির আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে দেশে এই টিকা উৎপাদন করতে পারব।’
প্রক্রিয়ার শুরু :
ওলা উইনকুইস্টের সঙ্গে পরিচিত বাংলাদেশ-বংশোদ্ভূত সুইডিশ অর্থনীতিবিদ শাহজাহান সায়েদ যখন শুকনো পাউডার টিকা আবিষ্কারের কথা জানতে পেরেছিলেন তখন এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
শাহজাহান তখন কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডা. আরিফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাংলাদেশে টিকাটির ট্রায়ালের জন্য।
ডা. আরিফুর তখন চার জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক— হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. চৌধুরী হাফিজ আহসান ও প্রফেসর ডা. মাসুদুল হাসান, নেফ্রোলজিস্ট প্রফেসর ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সাদেক এবং জাতিসংঘের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মাহমুদ উশ সামস চৌধুরীকে বাংলাদেশে ট্রায়াল শুরু করার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
প্রফেসর আবদুল্লাহ এবং প্রফেসর কবির তখন ট্রায়ালের জন্য একটি প্রটোকল প্রস্তুত করেন। ডা. আরিফুর এতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং সুইডেন থেকে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন।
ডা. আরিফুর জানান, কোভিডের কারণে বাংলাদেশ ভয়াবহভাবে ভুগছে। তাই তারা এগিয়ে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘এখন সবকিছু প্রায় প্রস্তুত। টিকার কোনো বিরূপ প্রভাব আছে কিনা সে বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন পাব বলে আশা করছি। জার্মান একটি সংস্থার কাছ থেকে প্রতিবেদন পেলে আমরা এটি সিআরও এর কাছে পাঠাব। যাতে এটি ট্রায়ালে নৈতিক অনুমতির জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারে।’
‘আমরা আশা করি ট্রায়াল সফল হবে এবং বাংলাদেশ কোভিড টিকা উৎপাদনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবে,’ তিনি বলেন।
প্রফেসর মাসুদুল বলেন, ‘সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হলে এটিকে আমরা জাতির জন্য একটি মহান সেবা হিসেবে বিবেচনা করব।’
‘দেশপ্রেম আমাদের প্রচেষ্টার পিছনে একমাত্র চালিকা শক্তি। আর কিছু নয়। সংকটের এই মুহূর্তে আমরা দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। এর আগে, আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভেন্টিলেটর এবং টিকার ব্যবস্থা করেছি এবং সেগুলো বাংলাদেশে পাঠিয়েছি,’ যোগ করেন তিনি।