বিশেষ ডেস্ক: আলোচিত মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। বছরজুড়েই কমেছে অভিযান, মামলা ও গ্রেফতার। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোতে এক পা এগোলে, পিছিয়েছে দুই পা। ফলে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও আলোচিত মামলার সুরাহা করতে পারেননি কর্মকর্তারা। কোনো কোনো মামলায় শুধুই দায় এড়াতে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই থেমে গেছে দুদক। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকের মতো আলোচিত দুর্নীতির মামলা বয়ে বেড়াচ্ছে সংস্থাটি। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত হয়নি গণশুনানিও। নিষ্পত্তি কমেছে ফাঁদ মামলার।
বছরের শেষে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ২০২১ সালের কার্যক্রম ও দুর্নীতি দমনে সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণে এমন চিত্রই উঠে এসেছে। ফলে দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটির সক্ষমতা নিয়েও আরও এক দফায় প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।
তবে দুদক সংশ্লিষ্টরা সংস্থার ‘দুর্বলতা’ এড়িয়ে সব সময় বলে আসছেন, শুধু দুদক দিয়ে দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। পরিবার থেকেই দুর্নীতি প্রতিরোধের শিক্ষা নিয়ে এই সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজ-রাষ্ট্রকে মুক্ত করতে হবে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দুদকে ১১ হাজার ৮২৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে জমা পড়েছে গড়ে এক হাজার ১৮৩টি অভিযোগ। তবে ২০২০ সালে মাসে গড়ে এক হাজার ৫৪১টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। ওই বছর মোট ১৮ হাজার ৪৮৯ অভিযোগ জমা পড়ে।
২০২০ সালে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৪৮৭টি অভিযান পরিচালনা করে। তবে চলতি বছরের ১০ মাসে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট অভিযান চালিয়েছে মাত্র ১১১টি। দীর্ঘদিন ধরে ‘ফাঁদ মামলা’ ও গণশুনানি বন্ধ ছিল। তবে নভেম্বরে কয়েকটি ফাঁদ মামলা ও গণশুনানি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও পুরোনো অভিযোগের অনুসন্ধান, তদন্ত ও অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করতেই বেশি সময় কাটছে দুদক কর্মকর্তাদের। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলার সংখ্যা এক হাজার ৩২২টি, যা মোট অনুসন্ধান ও মামলার এক-চতুর্থাংশ।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, নতুন কমিশন ও করোনার কারণে দীর্ঘদিন কার্যক্রমে গতি পায়নি। তবে নতুন কমিশন দ্রুতই নিষ্পত্তি না হওয়া অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে গুরুত্ব সহকারে কাজ করছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে চলতি বছরের ৩ মার্চ দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় সরকার। একই দিনে দুদকের কমিশনারের দায়িত্ব পান মো. জহুরুল হক। তিনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান। ১০ মার্চ থেকে চেয়ারম্যান ও সচিব আনুষ্ঠানিকভাবে দুদকে কার্যক্রম শুরু করেন।
মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ দুদক চেয়ারম্যান পদে ইকবাল মাহমুদের স্থলাভিষিক্ত হন। জহুরুল হক দুদকের কমিশনার (তদন্ত) পদে এ এফ এম আমিনুল ইসলামের স্থলে দায়িত্ব আসেন। দায়িত্বগ্রহণের পর অনুসন্ধান, তদন্তে দীঘসূত্রতা কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তার প্রতিফলন ছিল না বছরজুড়ে।
হলমার্ক-বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি যেন গলার কাঁটা
আলোচিত অনেক মামলার নিষ্পত্তি করতে পারছে না দুদক। এরমধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি সংস্থাটির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছয় বছরেও বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিবেদন দিতে পারেনি দুদক। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া ৫৬টি মামলার দৃশ্যমান তেমন অগ্রগতিও নেই। মামলাগুলো নিয়ে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, ঋণের নামে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। ২০১৫ সালে দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাতের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় ৫৬টি মামলা করে সংস্থাটি। এসব মামলায় আসামি করা হয় ব্যাংকটির কর্মকর্তা, ঋণগ্রহীতাসহ ১২০ জনকে।
বিগত ছয় বছরে বিদায় নিয়েছেন দুদকের দুজন চেয়ারম্যান। তবে বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংককাণ্ডে করা মামলাগুলোর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি দুদক।
জানা যায়, কোনোরকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পরিচালনা পর্ষদে প্রভাব খাটিয়ে কয়েকশো ব্যক্তিকে হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যার আবদুল হাই বাচ্চু। মূলত ঋণের নামে এসব অর্থ লুট করা হয়েছে। লোপাটের ঘটনায় আবদুল হাই বাচ্চুসহ দেড় শতাধিক ব্যক্তির সম্পৃক্ততাও মিলেছে দুদকের তদন্তে। ২০১৭ সালে দুবার ও ২০১৮ সালে একবার আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই দায় শেষ করেছে দুদক।
বেসিক ব্যাংকের মতোই দীর্ঘ আট বছর ধরে হলমার্ক কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান ও তদন্তের ভার বয়ে বেড়াচ্ছে দুদক। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি ৪১টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে হলমার্ক নামের অখ্যাত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়।
২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে ফান্ডের মোট এক হাজার ৯৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৩ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৩৮ মামলায় ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে সক্ষম হয় দুদক। এরপর থেকে কার্যত স্থবির মামলাটির কার্যক্রম। লোপাট হওয়া টাকার মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের কাছ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বাকি টাকা এখনো অনাদায়ী। যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকের মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, ‘অনন্তকাল ধরে কিছুই চলতে পারে না। আমরা দ্রুতই চেষ্টা করছি মামলাগুলো শেষ করার। আশা করি, খুব দ্রুতই শেষ হবে সবকিছু।’
পি কে হালদারের মামলায়ও স্থবিরতা
আর্থিক খাতে অনিয়মের আরেক নাম পি কে (প্রশান্ত কুমার) হালদার। এই কাণ্ডের তদন্ত চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে রিলায়েন্স ফিন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকাকালীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে কানাডায় পালিয়েছেন পি কে হালদার।
২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল।
অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় পি কে হালদারসহ ৮৩ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১১ জন। জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে। গ্রেফতাকৃতদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছাড়াও তার সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক এবং সর্বশেষ পি কে হালদারের বান্ধবী অবান্তিকা বড়াল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সংস্থাটি।
একইভাবে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও স্বাস্থ্যখাতের অনিয়মের তদন্ত চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
দুদকের কার্যক্রমে এমন ‘গা-ছাড়া’ মনোভাবের পেছনে নেতৃত্বকে দায়ী করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই দুদকের কাজে ভাটা পড়েছে।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাস সংকটকালে অভাবনীয় দুর্নীতির বেশ কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে। দেশে যে দুর্নীতি সর্বব্যাপী রূপ নিয়েছে, তা এসব ঘটনা দেখলেই স্পষ্ট হয়। এটা এখন অপ্রিয় সত্য।
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। কাজেই একটি ক্ষেত্রে এটি ঘটে থাকলে অন্যক্ষেত্রে কেন হবে না। চেষ্টা থাকলে অবশ্যই সেটা সম্ভব।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারি প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট হচ্ছে। গণমাধ্যমে আমরা সে খবর দেখছি। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বা তদন্ত করার কোনো উদ্যোগ দেখছি না। দুর্নীতি থেকে মুক্তি চাইলে দুদককে আরও বেশি কার্যকর হতে হবে।
দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, দুদকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে শুধু দুর্নীতিবাজদের ধরে একটি সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দুরূহতম কাজ। আইন প্রয়োগ করে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।
দুদকের কার্যক্রমে উল্টো সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সংস্থার চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি দায়িত্ব পালনে মাঠে থেকেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আক্রান্ত হয়েছেন মহাপরিচালক ও পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। দুদকের একজন পরিচালকসহ তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন।