শ্যামনগরে আদিবাসী মুন্ডারা তাদের ভোগদখলীয় সরকারি খাস জমি থেকে প্রভাবশালীদের দ্বারা অপসারিত হচ্ছেন। খবরটি জানতে পেরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকসহ শ্যামনগরের বাদোঘাটায় চারু মুন্ডার বাড়িতে গেলাম। দেখলাম তারা তাদের দখলীয় জমিতে থাকা অবস্থায় ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গোয়াল ঘরটি নতুন করে নির্মাণ করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে পালিত গরু ও মানবসন্তানকে এক সাথে বসতঘরে থাকতে হচ্ছে তাদের। পরদিন পত্রপত্রিকায় খবরটি পরিবেশিত হয়।
মূল আলোচনায় যাবার আগে এ বিষয়টি না বললেই নয়। কারণ যাতায়াতের পথে আমি পথেঘাটে গাছে গাছে বহু মানুষের হাসি দেখলাম। হাসি দেখে আমারও হাসি জাগলো। কিন্তু মুন্ডাদের দুঃসময়ের সাথে তাদের হাসি মেলাতে পারছিলাম না। ভেবেই নিলাম নেতাদের এই হাসির ঢেউ নিশ্চয়ই নির্বাচনের পর আছড়ে পড়বে মুন্ডাদের ওপর।
যাদের হাসি দেখলাম তাদের কথাই বলছি। জানলাম আগামি সংসদ নির্বাচনে তারা সবাই প্রার্থী হচ্ছেন। তাই ঈদ শুভেচ্ছা জানাতে তারা ফেস্টুন প্লাকার্ডে থেকে দিব্যি গাছে ঝুলতে শুরু করেছেন। কেউ গাছে কেউ ভবনে কেউ খুঁটির মাথায়, কেউ বৈদ্যুতিক খুঁটিতে দখিনা বাতাসে দুলছেন আর হাসছেন। জানা গেল ৩০০ টাকা দিলে নিজের ছবিসহ এক একটি প্লাকার্ড অথবা ফেস্টুন পাওয়া যায়। ১২০০ টাকা খরচ করলে অনেক বড় এবং ভালো ছবি প্লাকার্ড মেলানো যায়। স্থানীয়রা বললেন যিনি যতো বড় মাপের তিনি ততো বেশি টাকা ব্যয়ে ফেস্টুন প্লাকার্ডগুলি তৈরি করে গাছে গাছে তুলে দিয়ে হাসছেন আর ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আমি আগামী সংসদ নির্বাচনে শ্যামনগর-কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা ৪) আসন থেকে যারা প্রার্থী হতে চান তাদের কয়েকজনের কথাই বলছি। মাত্র কয়েক ঘন্টা শ্যামনগরে ঘুরে ফিরে জানলাম তাদের কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঝড় বৃষ্টিতেও গাছে গাছে খুঁটিতে যারা দোল খাচ্ছেন তারা সবাই আমার তো বটেই আমজনতার পরিচিত প্রিয় মুখ। তাদের প্রত্যেকের সাথে রয়েছে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সখ্য। হাসিমুখে দোল খাওয়া এসব নেতা নির্বাচনী প্রচার দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বর্তমান সাংসদ এসএম জগলুল হায়দারের কথা বলি। তিনি জনগণের কাতারে মিশে নিজেকে একাকার করে ফেলেছেন। মাটি কেটে ঝুড়িতে তুলে মাথায় নিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করেছেন। ঈদে নিজের ব্যবহারের জন্য কেনা পাঞ্জাবিটা একজন দরিদ্র ভ্যান চালককে দিয়েছেন। ঘর্মাক্ত ভ্যান চালককে দাঁড় করিয়ে তাকে ডাব খাইয়েছেন। সর্বশেষ নিজ হাতে লাঙলের মুঠি ধরে জোড়া বলদ নিয়ে ঠাঁয় ঠাঁয় ডানে বাঁয়ে করে জমি চাষ করেছেন। বৃক্ষ শাখায় ঝুলন্ত আরেক নেতা আতাউল হক দোলন সংসদ নির্বাচন করার আগ্রহ নিয়ে বেশ জনসংযোগ করছেন। তিনি ছোটবড় সমাবেশ করছেন। মানুষের সমস্যা নিয়ে সালিশ বিচার করছেন। ছুটছেন গ্রামে গ্রামে। দলীয় নানা কর্মসূচি পালন করে নিজেকে জনঘনিষ্ট করে তুলছেন। গাছে দুলে ঝুলে হাসিতে ভরা আরেক নেতা এইচএম গোলাম রেজা। জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করে ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর থেকে নিজ এলাকায় বারবার এলেও নানা কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় শ্যামনগরের মানুষ তাকে আর দেখতে পান না। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন শ্যামনগরে নিজ বাড়িতে। ঢাকাবাসী এই নেতা পবিত্র রমজানে নানা স্থানে ইফতারি দিয়ে মানুষকে জাগরিত করে গেছেন। প্রকারান্তরে ভোট চেয়েছেন। বলেছেন আবারও জোটের হয়ে প্রার্থী হবো। না হলে এককভাবে জাতীয় পার্টির। তবে জাতীয় পার্টির আরেক কেন্দ্রীয় নেতা সাত্তার মোড়ল একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনিও রমজানে কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের বিভিন্ন স্থানে ইফতারি দিয়ে জনগনের কাতারে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তবে তাকে আমি গাছে ঝুলতে দেখিনি। গাছে ঝুলতে দেখিনি এমন আরও এক রাজনীতিক ভোটের মাঠ বেশ গরম করে গেলেন। তিনি হলেন কাজী আলাউদ্দিন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি তৎকালিন সাতক্ষীরা ৪ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময়কার একটি কাহিনী আমার মনে পড়েছে। জাপা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচনী প্রচারে এসেছিলেন দেবহাটার সখিপুর কলেজ মাঠে। সেখানে ১৯৯৬ তে সাংসদ নির্বাচিত শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে তিনি বলেন ‘আমি শাহাদাতকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলাম। তিনি জয়ী হলেন। কিন্তু তিনি ঈমান রাখেন নি।’ জেনারেল এরশাদ জনসভায় আরও বলেন ‘আজ এই আসনের জন্য একজন ঈমানদার লোককে রেখে গেলাম। হাসিতে ভরা আলাউদ্দিনের হাত উঁচিয়ে এরশাদ বলেন তিনি হচ্ছেন কাজী আলাউদ্দিন। তিনিই জাতীয় পার্টির প্রার্থী। কাজী আলাউদ্দিন সত্যিই নির্বাচনে জিতলেন। কিন্তু তিনি এরশাদকে ছেড়ে হঠাৎ যোগ দিলেন জাপা ( নাফি)তে। এরশাদের সেই ‘ঈমানদার ব্যক্তি’ কাজী আলাউদ্দিন কিছুদিন বাদে বললেন আমি বিএনপিতে যোগ দিয়েছি। অথচ বিএনপির তখনকার জেলার শীর্ষ নেতারা তা জানতেনই না। কাজী সাহেব অবশ্য বলেছিলেন তিনি ঢাকায় দলের মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার সাথে সাক্ষাত করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। সেই এমপি কাজী আলাউদ্দিন জাতীয় সংসদে মোনাজাত পরিচালনাকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ হিসাবে আখ্যায়িত করে চরম সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এবার শুনছি তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের লোক। শেখ হেলালের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে তিনি বলছেন এবার তিনি শ্যামনগর আসনে নির্বাচন করতে প্রস্তুত। যে কোনো জোট থেকে তিনি মনোনয়ন নেবেন। পাঠক আমি বড্ড ধন্দে পড়ে গেছি। এরশাদের কাছে সেই ঈমানদার ব্যক্তি কাজী আলাউদ্দিন এখন কোন দলের বিএনপি, জামায়াত, জাপা নাকি হেলাল সাহেবের লোক হিসাবে আওয়ামী লীগের? নির্বাচনে অন্য যে সব নেতা আসছেন তারাও বোধ করি ঠাওর করতে পারছেন না কাজী সাহেব কার। সময় ও প্রতীক হয়তো বলে দেবে তিনি কোন দলের। আমি শ্যামনগরের গাছে গাছে হাসিতে আরও ঝুলতে দেখেছি গাবুরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা জিএম শফিউল আজম লেনিনকেও। লেনিন নানা ঘটন অঘটনের পর স্বেচ্ছা নির্বাসনে ঢাকায় গেছেন বেশ কিছুকাল আগে। এখন সামনে নির্বাচন, তাই তিনিও শ্যামনগরে ঢোল পিটিয়ে বলে গেলেন আমি প্রার্থী। আবারও বলছি নেতাদের হাসিতে আমারও হাসি লেগেছে। কারণ হাসিতে হাসি আনে, ক্রন্দনে আনে কান্না।
আমার প্রত্যাশা শ্যামনগরের মুন্ডাদের হাসি যেনো উবে না যায়। তারাও যেনো বৃক্ষ শাখে ঝুলন্ত নেতাদের মতোই হাসতে পারেন।
লেখক : সাতক্ষীরা ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি।
পূর্ববর্তী পোস্ট