টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রশাসনে হঠাৎ করেই বেড়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের দাপট। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ পদগুলোয় বহাল এসব কর্মকর্তার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কোণঠাসা সরকার সমর্থকরা।
শুধু তাই নয়, সরকারের প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদও পাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত-সম্পৃক্তরাই। নানান কৌশলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও বাগিয়ে নিচ্ছেন তারাই। অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বর্ণচোরা এসব কর্মকর্তা সৃষ্টি করছেন সমন্বয়হীনতার। এ নিয়ে জনপ্রশাসনে এখন চলছে নীরব অসন্তোষ।
প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও আসলে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছেন কারা? জানা যায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন চলমান উন্নয়নকাজের প্রকল্প পরিচালকদের রহস্যজনক আচরণে থমকে গেছে কাজের স্বাভাবিক গতি। জাতীয় নির্বাচন যখন আসন্ন তখন প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করতে চাইছেন বলেও নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রের আভাস। এসব কর্মকর্তাকে দ্রুত চিহ্নিত করতে না পারলে প্রশাসনে সরকারবিরোধী মহলের শক্ত অবস্থান তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। সূত্রমতে, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই ঘাপটি মেরে আছেন সরকারবিরোধী একাধিক কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের শতাধিক কর্মকর্তা ভিন্ন মেরুর সমর্থক হলেও বর্তমান সরকারের আমলে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপসচিব পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে ছিলেন বিএনপি সমর্থক। তাদের একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিতে ছিলেন বলেও নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। বিএনপিপন্থি এ দুই কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের আমলে সব সময়ই আছেন সুবিধাজনক অবস্থানে। তারা ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন প্রশাসনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের আশীর্বাদে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, শেরেবাংলানগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের শিবির নেতা বর্তমানে যুগ্ম-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে। বিতর্কিত এই কর্মকর্তার বাড়ি বাগেরহাটে। কৃষক লীগের সাবেক এক সাধারণ সম্পাদকের আপন ভায়রা হওয়ার সুবাদে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা নিজের পরিচয় লুকিয়ে সব ধরনের সুবিধা নিচ্ছেন প্রশাসন থেকে।
প্রশাসনের এক দাপুটে কর্মকর্তা যশোরের সাবেক জেলা প্রশাসক। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তা ছাত্রজীবনে সরাসরি জড়িত ছিলেন বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে। যশোরে তাকে জেলা প্রশাসক বানাতে নেপথ্যে সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন জনপ্রশাসনের দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এর মধ্যে একজন নিজেও একসময় শিবির ক্যাডার ছিলেন বলে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে। প্রশাসনে সরকার সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে জোর গুঞ্জন রয়েছে, যশোরের সাবেক সেই জেলা প্রশাসককে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পদ এপিডি হিসেবেও নিয়োগের চেষ্টা চলছে। সে ক্ষেত্রে একটি মহল জোর লবিং চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। প্রশাসনের যুগ্ম-সচিব পদবির আরেক কর্মকর্তা একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তিনি ছিলেন সাবেক ভূমি উপমন্ত্রীর আস্থাভাজন। এই কর্মকর্তা এখনো দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনের অষ্টম ব্যাচের অন্য এক কর্মকর্তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বিএনপি সরকার আমলে। এক হুইপের পিএসের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ মুহূর্তে চলে আসেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এ বিভাগে থাকাবস্থায়ই তিনি পরপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদোন্নতি পেয়ে এখন দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নবম ব্যাচের এক কর্মকর্তা বিএনপি সরকার আমলে ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে প্রশাসনের অভ্যন্তরে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি।
২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের আমলে প্রশাসনে তার ছিল যথেষ্ট প্রভাব। বিতর্কিত এই কর্মকর্তা কয়েকবার উপসচিবের তালিকা থেকে বাদ পড়লেও বর্তমানে তিনি আবার দাপুটে কর্মকর্তা। প্রশাসনের ১৯৮৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ছিলেন সিলেট ও রাঙামাটির জেলা প্রশাসক। বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের প্রধান ভূমিকায় তিনিই রয়েছেন। প্রশাসনে ’৮৫ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে।
বিএনপি সমর্থিত এই কর্মকর্তাকে ঘিরে প্রশাসনের অভ্যন্তরে রয়েছে নানামুখী গুঞ্জন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকাবস্থায় স্থানীয় আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণে কৌশলে অসহযোগিতা করেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে বর্তমানে কর্মরত এক কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর পিএস। প্রশাসনে ছিল তার অভাবনীয় প্রভাব। বর্তমান সরকার আমলেও তার প্রভাব বেড়েছে। সূত্রমতে, যুগ্ম-সচিবের সম্ভাব্য পদোন্নতির তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করতে জোর লবিং চালাচ্ছেন তিনি।
৮২ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ছিলেন নরসিংদীর জেলা প্রশাসক। বর্তমানে তিনি ব্যাপক প্রভাবশালী। ৮২ ব্যাচের অন্য এক কর্মকর্তা বর্তমানে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। বিএনপি সমর্থিত কমকর্তা হিসেবে তৎকালীন জোট সরকারের আমলে তার ছিল ব্যাপক ক্ষমতা। ছিলেন পর্যায়ক্রমে কুড়িগ্রাম ও ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক। বিএনপি আমলে যেভাবে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সেই প্রভাব এখনো বহাল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন ’৮৫ ব্যাচের এক কর্মকর্তা, এ ছাড়া জোট আমলে কক্সবাজারের সাবেক দুই জেলা প্রশাসক বর্তমান সরকারের আমলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা। তাদের নিয়ে প্রশাসনে সরকার সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন