অনলাইন ডেস্ক : শারীরিক অসুস্থতার কারণে ছুটিতে যাওয়া প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অস্ট্রেলিয়ায় ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। একমাসের ছুটিতে যাওয়ার দুই দিন পর গতকাল সকালে প্রথম প্রকাশ্যে বেরিয়ে তিনি গুলশান-২ নম্বরে অবস্থিত ভিসা সেন্টারে উপস্থিত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বড় মেয়ে বসবাস করেন।
গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বাসভবন থেকে দ্বিতীয় দফা বেরিয়ে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সস্ত্রীক যান প্রধান বিচারপতি।
এর আগে বিকেল চারটার দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেখতে তাঁর সরকারি বাসভবনে যান। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কথা হয়েছে, আমাকে তাঁর জন্য দোয়া করতে বলেছেন।’
বিদেশে যেতে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ভিসার আবেদন নিয়ে কথা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি, আমিও উনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।’
দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা গতকাল সকালে আদালতে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, উনি (প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) তাঁর বাসভবনে আছেন। তিনি কার সঙ্গে দেখা করবেন বা করবেন না, এটি তাঁর ব্যাপার। আমরা কি নির্দেশনা দিতে পারি?’ ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা না করতে পারা এবং তাঁর সঙ্গে আইনজীবী নেতাদের সাক্ষাৎ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির তুলে ধরা এক মৌখিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৩ অক্টোবর থেকে এক মাসের ছুটিতে আছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ছুটি গ্রহণের দুই দিন পর পূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে প্রথম তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়।
প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে গতকালও আদালতপাড়ায় ছিল নানা আলোচনা। বিকেল পাঁচটার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সভাপতিসহ নেতারা দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। এর আগে সমিতির সংখ্যাগরিষ্ঠ পদে থাকা আইনজীবীরা (বিএনপি-সমর্থক) এবং কমিটিতে থাকা অপর অংশ (সরকার-সমর্থক) পৃথক ব্রিফ করেন। দুপুরে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটিতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে একদল আইনজীবী প্রতিবাদ সমাবেশসহ বিক্ষোভ মিছিলও করে।
‘আমি নিশ্চিত, উনি তাঁর বাসভবনে আছেন’
সকাল ৯টা ৫ মিনিটের দিকে এজলাসে আসেন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর চারজন বিচারপতি। আসন গ্রহণের পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘গত ২ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৫টায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবনে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত আইনজীবী সমিতি উদ্বিগ্ন।’
এই পর্যায়ে আদালত বলেন, বিষয়টি সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে (আপিল বিভাগের এখতিয়ারসংক্রান্ত) পড়ে কি না? এ সময় জয়নুল আবেদীন আইনজীবী সমিতি বিশেষ করে সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক কীভাবে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে দেখা করতে পারেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আরজি জানান।
এ সময় দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আইনের অধীন। জেনেছি উনি অসুস্থতার জন্য পারফর্ম করতে পারছেন না। তাই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি। আমি নিশ্চিত, উনি তাঁর (প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) বাসভবনে আছেন। তিনি কার সঙ্গে দেখা করবেন বা করবেন না, এটি তাঁর ব্যাপার। আমরা কি নির্দেশনা দিতে পারি?’
একপর্যায়ে আইনজীবী মইনুল হোসেন বলেন, ‘এটি বিচার বিভাগ ও আপনাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আপনাদের কাছে এসেছি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তিনি অসুস্থ, আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানালাম।’ আইনজীবীদের প্রতিনিধিদল যাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে পারেন, সে ব্যবস্থার আরজি জানান তিনি।
এর একপর্যায়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতির অসুস্থতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ। রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে তাঁর অবস্থা জানিয়ে একটি বক্তব্য দেওয়ার জন্য আরজি জানান তিনি।
সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছি, দেখা করতে পারিনি। এরপর দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনাদের কথা শুনলাম, উদ্বেগ জানিয়েছেন। আমরা চিন্তা করে দেখব।’
পরে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে আইনজীবীরা প্রার্থনা করেছেন, যেন তাঁর সঙ্গে (প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) দেখা করতে পারার জন্য একটি আদেশ দেওয়া হয়। তখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি তাঁদের তথা আপিল বিভাগের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের বলেছেন, তিনি যেদিন ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, বার সদস্যদের অর্থাৎ সমিতির যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের সেদিনই উচিত ছিল উনার (বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা) সঙ্গে দেখা করার। তাঁরা সেটা করেননি। প্রকাশ্য আদালতে এ রকম প্রার্থনা না করে চেম্বারে গিয়েও তাঁরা তাঁদের এই উদ্বেগ জানাতে পারতেন। যা-ই হোক, তাঁদের প্রার্থনায় আদালত কোনো রকম আদেশ প্রদান করেননি।
পরে বিকেল ৫টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে তাঁর দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন। সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন জানান, দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি তাঁদের বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনজীবীদের সাক্ষাতের বিষয়টি তিনি আইনমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। আইনমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারও বাধা নেই। তবে প্রধান বিচারপতি কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।
এর আগে বিকেল চারটায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে আইনজীবীদের পূর্বনির্ধারিত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, এতে জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ জ্যেষ্ঠ কয়েকজন আইনজীবী এতে অংশ নেন। তবে সমিতির সহ-সভাপতি মো. ওয়াজি উল্লাহসহ নির্বাহী কমিটিতে থাকা সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত অপর ছয় জন এতে অংশ নেন নি।
দুই দিন পর বের হলেন প্রধান বিচারপতি
৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যাওয়ার পর দুই দিন (৩ ও ৪ অক্টোবর) বাসভবনে অবস্থান শেষে গতকাল প্রথম জনসমক্ষে বের হন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। প্রধান বিচারপতিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে গতকালই বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, গতকাল রাজধানীর হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবন থেকে দুপুর ১২টার দিকে প্রধান বিচারপতি গুলশান ২ নম্বরে অবস্থিত ভিসা সেন্টারে পৌঁছান। সেখানে তিনি আধঘণ্টার মতো অবস্থান করেন। ভিসা আবেদনের প্রক্রিয়া শেষে তিনি বাসভবনে পৌঁছান। পাঁচ বছরের ভিসার জন্য আবেদন করা হয়।
এরপর ৫টা ২৫ মিনিটে তিনি আরেক দফা বের হন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে লক্ষ্মীপূজার আনুষ্ঠানিকতা উপলক্ষে। তাঁর গাড়িবহর কদম ফোয়ারা, দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পৌঁছায় বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে। তিনি সস্ত্রীক মন্দিরের মূল অংশে গিয়ে পূজার আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। এরপর তাঁরা মন্দিরের প্রশাসনিক ভবনের দোতলার অতিথি কক্ষে যান। এ সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে বড় মেয়ের ফোন এলে তিনি ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
সন্ধ্যা ৬টা ১১ মিনিটে প্রধান বিচারপতি মন্দির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন।
দেখা করতে গেলেন আইনমন্ত্রী
প্রধান বিচারপতি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশে বের হওয়ার আগে আগে তাঁর হেয়ার রোডের বাসভবনে যান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিকেল ৪টা ৫ মিনিট থেকে ৪টা ৩৯ মিনিট পর্যন্ত আইনমন্ত্রী সেখানে অবস্থান করেন। এরপর তিনি বেরিয়ে যান।
প্রধান বিচারপতি আইনমন্ত্রীকে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। এ সময় প্রধান বিচারপতির পরনে ধূসর রঙের একটি পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরা ছিল। আইনমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে জড়ো হওয়া সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা না বলেই চলে যান।
দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
এর আগে দুপুরে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ওনার দায়িত্ব পালনে আমার সম্পূর্ণ সহযোগিতার কথা বলেছি। এর আগে প্রধান বিচারপতি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন তাঁদের বলেছিলাম যে আইন মন্ত্রণালয় হচ্ছে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সেতুবন্ধন। সে কথাই আবারও বলেছি এবং সহযোগিতার কোনো কমতি হবে না, এটাও বলেছি।’
সাক্ষাতের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য বিচারপতিরা ছিলেন কি না, এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একসময় আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতিও এসেছিলেন। ওনাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে।’
সূত্র: প্রথমআলো।