গাইড বই থেকে যাতে শিক্ষকরা কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন না করেন সে ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। অথচ এগুলো আমলে না নিয়ে গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন অব্যাহত রয়েছে। স্কুল কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার অধিকাংশ প্রশ্নই গাইড বই থেকে হুবহু নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। বিভিন্ন প্রকাশনীর গাইড বই সংগ্রহ করে সেখান থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন করেন শিক্ষকরা। প্রশ্ন প্রণয়ন করতে ব্যর্থতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়ন না করতে বিভিন্ন সময় হুঁশিয়ারি ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ২০১৫ সাল থেকেই গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়নের চিত্রটি সবার সামনে প্রকাশ পায়। ওই সময় থেকে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের সতর্ক করেন। শিক্ষকদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালাও সমাবেশে প্রশ্ন প্রণয়নের বিষয়ে মন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনাও ছিল। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের বলেছেন, ‘গাইড ও নোট বই থেকে কোনোভাবেই প্রশ্ন প্রণয়ন করা যাবে না, যারা এসব করবেন তাদের বিরুদ্ধে মামলাসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোচিং নির্ভরশীল শিক্ষকদের প্রশ্ন প্রণয়নে দায়িত্ব দেওয়া হলে সে জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু মন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে সাড়া মেলেনি।
গত বছর জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নের প্রমাণ পাওয়া যায়। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন হুবহু গাইড বই থেকে তুলে দেওয়া পাঁচ শিক্ষককে প্রশাসনিক শাস্তি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দুর্গম স্থানে তাদের বদলি করা হয়। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এছাড়া এসএসসি পরীক্ষায় পদার্থ বিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নে একটি গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এ ঘটনায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা অভিযোগও করে বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এবারও এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়নের প্রমাণ মেলে।
অভিভাবকরা বলছেন, অনেক শিক্ষকই নোট গাইড প্রণয়নের সাথে জড়িত। বিভিন্ন নোট গাইড প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করছেন তারা। আরিফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, স্কুলের প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্ন হয় গাইড বই থেকে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা গাইড বই পড়ার প্রতি আগ্রহী। মূল বই পড়ে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এ অবস্থা তৈরির জন্য দায়ী শিক্ষকরাই।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়নের ৭ বছর চলছে। তবে এখনও এ পদ্ধতি নিয়ে বিপাকে শিক্ষার্থী অভিভাবকরা। শুধু তাই নয়, রীতিমতো শিক্ষকরাও এ পদ্ধতি এখনও আয়ত্ত করতে পারেননি। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষকরা। শিক্ষকরাও এ পদ্ধতি এখনও আয়ত্ত করতে না পারায় প্রশ্নও প্রণয়ন করতে পারছেন না।
শিক্ষকরা যে এ পদ্ধতি এখনও বুঝছেন না তার প্রমাণ মেলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত সরকারি এক জরিপে। এই জরিপে দেখা যায়, এখনও দেশের ৫২ ভাগ শিক্ষক নিজে স্কুলের পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন না। এর ৩০ ভাগ শিক্ষক অন্য শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন করেন। আর বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেন ২২ ভাগ শিক্ষক।
শিক্ষা ক্যাডারের ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় : গাইড বই থেকে প্রশ্ন এবং প্রশ্নে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় যুক্ত করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছর অনুষ্ঠিত যশোর শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার গাইড বই থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এছাড়া রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় অপ্রাসঙ্গিক বিষয় প্রশ্ন করা হয়।
এইচএসসির প্রশ্ন ত্রুটির জন্য অভিযুক্ত করে এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসাবে চলতি সপ্তাহে অভিযুক্ত পাঁচ শিক্ষকের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, কর্মস্থল, চাকরিতে যোগদানের তারিখ, বেতন স্কেল, আহরিত বেতন ভাতার তথ্য চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গাইড বই থেকে আইসিটি বিষয়ে প্রশ্ন করার কারণে সরকারি নুরুন্নাহার সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক আনিছুর রহমান এবং যশোরের সরকারি এম এম কলেজের সহকারি অধ্যাপক এস এম তালেবুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জড়িত নওগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার সাহা, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের সহকারি অধ্যাপক আবুল মজন চৌধুরী এবং নাটোরের এন এস সরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক সাইফুল ইসলামকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এর আগে সকলকেই কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারনেনি। এসব শিক্ষককে ইতিমধ্যে সকল পরীক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
গত আগস্ট মাসে অভিযুক্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছিল। তার কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, পৌরনীতি ও সুশাসন প্রথমপত্র বিষয়ে বহুনির্বাচনী অংশে ৮,৯,১০ ও ১১ নং প্রশ্নে ও উদ্দীপকে যে প্রশ্নপত্র সমীক্ষণ করেছেন তার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই শিক্ষককে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি মডারেটর ছিলাম। প্রশ্নে কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় রয়েছে উল্লেখ করে আমাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। আমি জবাব দিয়েছি। এরপরও কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে আমি বোধগম্য নই।