দেশের খবর: ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। দেশে প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। মাত্র দেড় দশকের ব্যবধানে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে পাঁচ লাখ টনের ঘর। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে একলাখ ৯৫ হাজার টন। ২০০২-০৩ অর্থবছরেও ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল একলাখ ৯১ হাজার টনের ঘরেই। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করায় ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯৫ হাজার টনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন চার লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, সদ্য সমাপ্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে, ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিশ্বের ৬০ শতাংশ ইলিশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। এ ছাড়া, ভারতে ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ১৫ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশ এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় বাকি ৫ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইরান, ইরাক, কুয়েত, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, বাহরাইন ও ইন্দোনেশিয়া। এসব দেশের উপকূলেও ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। তবে এসব দেশে সম্প্রতি ইলিশ উৎপাদন কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশেই প্রতিবছর ৯-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। কারণ ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় বাংলাদেশের সীমানাকে। এজন্য বর্ষায় এ দেশের নদীগুলো ‘মা’ ইলিশে ভরে ওঠে। মোহনা থেকে নদীর ১২০০-১৩০০ কিলোমিটার উজানে ও উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রে ইলিশ পাওয়া যায়। দিনে ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে ইলিশ। সাগর থেকে ইলিশ যত ভেতরের দিকে আসে, ততই শরীর থেকে লবণ কমে যায়। এতে স্বাদ বাড়ে ইলিশের।
এ দিকে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান এক দশমিক ১৫ শতাংশ। এদেশের মোট মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। এর অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আসে ১৫০-৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানান, উপকূলীয় মৎসজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি সম্পৃক্ত। আরও ২০-২৫ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। তারা পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত।
তিনি আরও জানান, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির মাছ এখন চাষ করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারিভাবেও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছ চাষ হচ্ছে। মাছ চাষে আরও গবেষণা হবে। এ ছাড়া, মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ইলিশ ধরা বন্ধকালীন জেলেদের নানা ধরনের সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে তার অর্ধেকও রক্ষা করা গেলে এবং সেগুলোর গড় ওজন ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে দেশে ইলিশের উৎপাদন আরও প্রায় দুই লাখ টন বাড়ানো সম্ভব। এজন্য সরকারি নজরদারি প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, প্রজনন মৌসুমে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইলিশ যেন ডিম ছাড়তে পারে ও ছোট ইলিশ যেন বড় হতে পারে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেই দেশের ছোট-বড় নদীগুলো আবার ইলিশে ভরে উঠবে।
চট্টগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মৃদুলা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইলিশের সঙ্গে বিশ্বের কোনও দেশের ইলিশকে মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের ইলিশ ব্যতিক্রম। পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলে এদেশে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য সরকারের আরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। জাটকা ধরা বন্ধ করতে হবে। ইলিশকে স্বাচ্ছন্দে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফল বলছে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেতো। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে এই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা থেকে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তবে জাটকা নিধনের কারণে ইলিশ মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট ইলিশকে জাটকা বলা হয়। ২০১২ সালে দেশে ১০ হাজার ৯০০ টন, ২০১৩ সালে সাড়ে ১১ হাজার টন, ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৮০০ টন জাটকা ধরা হয়। এগুলোর আকার ১৪-২০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। আর ওজন গড়ে ৩০ গ্রাম। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৩৮ কোটি জাটকা ইলিশ ধরা পড়ছে দেশে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি ইলিশ একসঙ্গে কমপক্ষে ৩ লাখ ও সর্বোচ্চ ২১ লাখ ডিম ছাড়ে। এসব ডিমের ৭০-৮০ শতাংশ ফুটে রেণু ইলিশ হয়। এর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, যা পরবর্তীতে ইলিশে রূপান্তরিত হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানান, জাটকা আহরণের নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের কথা ভেবে সরকার ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় চাল দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে। এ পর্যন্ত মোট ৪২ হাজার ৬১৫টি জেলে পরিবারকে তাদের চাহিদানুযায়ী নানা উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৭৬টি জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি হারে ৩৭ হাজার ৭৮৮ টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।