বিশেষ ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার পাওয়ারহাউস খ্যাত দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশের তকমা এখন ভারতের। তবে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে থাকা ভারত খুব শিগগিরই প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছে এই তকমা হারাতে যাচ্ছে। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে ভারতকে। ছোট প্রতিবেশী বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তেও রয়েছে।
এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। একই সময়ে ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এই সময়ে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
একই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ভারতের মাথাপিছু আয়ের গতির প্রায় তিনগুণ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ, বাংলাদেশের বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।
বেশ কিছু পূর্বাভাস বলছে, আগামী দুই বছর যদি স্থুল জাতীয় আয় (জিএনআই) ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির বর্তমান গতি ধরে রাখতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে ২০২০ সালের মধ্যে মোট মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে দেশটি।
এক দীর্ঘযাত্রা
পাকিস্তানের দারিদ্রপীড়িত একটি অঞ্চল থেকে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার মাইনাস ১৪ শতাংশ রেকর্ড করা হয়েছিল। দুই বছর পর বাংলাদেশ ৯ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হারের সাথে এগিয়ে চলছিল। কিন্তু এই সময়ে এক প্রলয়ঙ্করী দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ফলে আবারো মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মাঝে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় মাইনাস ৪ শতাংশ।
দুর্ভিক্ষের পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় পুনরায় দেশের উন্নয়ন কাজ শুরু করে সরকার। এনজিওগুলোও উন্নয়নকাজে সহায়তায় এগিয়ে আসে। ১৯৭০ সালে উচ্চ-ফলনশীন ধান ও গম চাষ শুরুর মাধ্যমে দেশের কৃষি প্রবৃদ্ধিতে বিপ্লব ঘটে।
বাংলাদেশের আজকের যে শক্ত অবস্থান এর পেছনে ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া ক্ষুদ্র-ঋণ ব্যবস্থার অবদান রয়েছে। এই ক্ষুদ্র-ঋণ পরবর্তীতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে সরকার শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) অর্থনীতিবিদ ও জ্যেষ্ঠ ফেলো জয়শ্রী সেনগুপ্ত বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রফতানি আয়ও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের মতো শ্রমশক্তিপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ; তবে ভারতের মতো কঠোর শ্রম আইন নেই।
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আগে ভারত শিল্প বিরোধ আইন পাস করে। কিন্তু বাংলাদেশ যখন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তখন দেশটিতে এধরনের কোনো আইন ছিল না। আর এটিই সস্তা শ্রম ও বর্ধনশীল উৎপাদন ঘাঁটি হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তিগুলোর একটি পোশাক শিল্প। ১৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ২.৭ শতাংশ (৪৪ লাখ) এই খাতের কর্মে নিয়োজিত; এর ৭০ শতাংশই (৩০ লাখ) নারী। সস্তা শ্রমশক্তির সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশে বৈশ্বিক বিনিয়োগও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকের ভারত
ভারতে তেলের উচ্চমূল্য, দুর্বল রফতানি ও রূপির অবমূল্যায়নের ফলে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবাহকে ধীরগতি করে তুলেছে। চলতি সপ্তাহে রূপির দাম এ বছরের সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে রূপির দাম রেকর্ড ৭৪ এ নেমে এসেছে সোমবার।
এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক কর্মকর্তা অভিজিত সেন গুপ্ত বলেন, আমরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৮ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দেখেছি এবং এতে মূলত গত বছরের অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল। তবে পরবর্তীতে আমরা এই প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হতে দেখেছি।
সেন গুপ্তের মতে, ভারত যদি তার প্রতিবেশীর অর্থনীতির সঙ্গে টেক্কা দিতে চায় তাহলে অবকাঠামো, উৎপাদন, সেবা ও রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে মনযোগ দেয়া উচিত। কেননা এসব খাতে কর্মসংস্থান তৈরির অবস্থা সঙ্কটজনক। তিনি বলেন, বিনিয়োগের পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধির জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে হবে।
সামাজিক অগ্রগতি
আয়ু বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার এবং লিঙ্গ সমতার মতো সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতির জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যান্সেটের প্রকাশিত মানব সম্পদ সূচকে বাংলাদেশের নিচে অবস্থান করছে ভারত। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মানুষের শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করেছে ল্যান্সেট।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের বেশি। গত বছর বাংলাদেশে ১০০০ হাজার শিশুর জন্মের প্রথম এক বছরের মধ্যে মারা গেছে মাত্র ২৭ জন। কিন্তু ভারতে এই হার ৩২। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৫৮ বছরে। অন্যদিকে, ভারতে মানুষের গড় আয়ু ৬৮.৮ বছর।
বাংলাদেশের অগ্রগতির নেপথ্যে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের এসব অগ্রগতির নেপথ্যে রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের মতো বেসরকারি সংস্থার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ। ক্ষুদ্র-ঋণের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত গ্রামীণ ব্যাংক। এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বের শতাধিক ব্যাংকটি তাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে; যা অনেকের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।
দারিদ্র দূরীকরণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে ঋণ-দান করে এই ব্যাংক; যারা প্রথাগত অন্যান্য ব্যাংক থেকে এই ঋণ পান না। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য বলছে, প্রায় ৭৫ লাখ গ্রাহককে স্বল্পসুদে সমবায়ের ভিত্তিতে ঋণ দিয়েছে; এই ঋণগ্রহীতাদের ৯৭ শতাংশই নারী।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারী ডিজিটাল লেনদেন করেছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় এই লেনদেনের গড় হার ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় ভারতের চেয়ে কম হলেও দেশটির সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার দেশটিতে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। ৪ থেকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, বিধবা ও বয়স্ক নারীদের জন্য ভাতা ব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মজীবীদের ৭০ শতাংশ এবং মৎস্য চাষীদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি নারী।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের লিঙ্গ সমতা সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শীর্ষে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের (১৫তম) চেয়ে আট ধাপ এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ (৭ম)। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৩৫০ আসনের মধ্যে ৫০টি নারীদের জন্য সংরক্ষিত; যা মোট আসনের প্রায় ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে, ভারতে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৫৪৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি রয়েছে ৬২ জন। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রেখে এখনো আইন পাসই হয়নি দেশটিতে।
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ড. এ কে শিব কুমার বলেন, বাংলাদেশের উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য টেকসই বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে মৌলিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে।
২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় শতভাগ স্যানিটারি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। ভারত এই সময়ে সবে মাত্র স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালে মধ্যে খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ ৪২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ ঠেকাতে ২০১৪ সালের শুরুতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’ প্রকল্প চালু করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় চলতি অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের ৭৬ শতাংশ গ্রামকে উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগমুক্ত ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে চালু হওয়া কমিউনিটিভিত্তিক শতভাগ স্যানিটেশন মডেলকে অনুকরণ করে স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ভারত।