দেশের খবর: ফেনীর সোনাগাজীতে দুর্বৃত্তদের আগুনে দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ (মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য) দিয়েছেন। নুসরাত তার বক্তব্যে বলেছেন, ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে তার শরীরে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে ওড়না পুড়ে গেলে তার হাত মুক্ত হয়।
বোরকা, নেকাব ও হাতমোজা পরা যে চার নারী তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন, তাদের একজনের নাম সম্পা বলে জানান নুসরাত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ঘটনার বিষয়ে নুসরাতের বক্তব্য নিয়েছেন একজন চিকিৎসক।
নিয়ম অনুযায়ী এ সময় দুজন সাক্ষীও উপস্থিত ছিলেন। আইনি ভাষায় এই বক্তব্যকে ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ বলা হয়। অর্থাৎ রাফি বেঁচে না থাকলে তার এই বক্তব্য ‘মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য’ হিসেবে বিবেচিত হবে। তার এ বক্তব্য মামলার বিচারকাজের সময় ব্যবহার করা হতে পারে।
সঙ্কটাপন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যে রাফি বলেছেন, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীদের শ্নীলতাহানি করতেন। তার কথায় রাজি না হলে তিনি নানাভাবে হেনস্থা করতেন। ২৭ মার্চ রাফির সঙ্গেও অধ্যক্ষ অশালীন আচরণ করেন।
সোমবার সকালে নুসরাত জাহান রাফিকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় বোরকা পরা চার নারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, সকালে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা দেখেন, তার অবস্থা ভালো নয়। তখনই তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
ফেনীর পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, ঘটনার তথ্য-প্রমাণ ও বোরকাপড়া চার তরুণীকে শনাক্তের জন্য এখন একজনকে প্রয়োজন, যে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়েছিল। পুলিশ তাকেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হবে। যত প্রভাবশালীই হোক, কেউ পার পাবে না।
গত শনিবার সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে যায় ওই ছাত্রী। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে ৪/৫ জন বোরকা পরিহিত ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
রোববার তার চিকিৎসায় ৯ সদস্যের বোর্ড গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরীক্ষা কেন্দ্রে ছাত্রীর ওপর এমন নির্মমতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সার্বিক চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেফতারেরও নির্দেশ দিয়েছেন। সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাতকে দেখতে যান।
এর আগে গত ২৭ এপ্রিল ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।
এদিকে এ ঘটনায় রোববার থেকে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসার স্বাভাবিক কার্যক্রম ও অনির্দিষ্টকালের জন্য হোস্টেল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
ওই ছাত্রীর স্বজনরা বলেন, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্নীলতাহানি করেন। ওই ঘটনায় থানায় মামলা করেন তার মা। ওই মামলায় অধ্যক্ষ কারাগারে রয়েছেন। মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের লোকজন হুমকি দিয়ে আসছিল বারবার। আলিম পরীক্ষা চললেও আতঙ্কে স্বজনরা পরীক্ষা কেন্দ্রের কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন। মামলা তুলে না নেওয়াতেই ক্ষিপ্ত হয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় নুসরাতকে।
ছাত্রীর বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, তার বোনের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া পূর্বপরিকল্পিত। অন্যান্য দিন তিনি বোনকে কেন্দ্রের কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দিলেও শনিবার তাকে কেন্দ্রেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মাদ্রাসার নিরাপত্তাকর্মী মোস্তাফা বাধা দেন তাকে। এর আগে সকালে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আফসার উদ্দীন ফোনে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেন। এ ছাড়া নিয়মিত হুমকি তো ছিলই। এসব হুমকিতেও মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার বোনকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।