দেশের খবর: সমাজের সবস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে আগামী রবিবার (১৪ জুলাই) থেকে শুরু হচ্ছে ৫ দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন। সম্মেলন চলবে ১৮ জুলাই পর্যন্ত। অতীতের দিনগুলোয় ডিসি সম্মেলন তিন দিনব্যাপী হলেও এবার দু’দিন বেড়ে হচ্ছে পাঁচ দিন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এবার ডিসি সম্মেলনে যুক্ত হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি ও জাতীয় সংসদের স্পিকারও। ১৪ জুলাই রবিবার সকাল দশটায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘শাপলা’ হলে এই সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এবারের ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেওয়া সিদ্ধান্ত ও কার্যসূচি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে বুধবার তার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কাল বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বেলা আড়াইটায় সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে তা জানানো হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কাছে সম্মেলনের খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরবেন।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত বর্তমান সরকারের প্রথম ডিসি সম্মেলনে সরকার জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রশাসনের সবস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি চাইবে। একইসঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে গতিশীলতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের নীতি-দর্শনের বাস্তবায়ন ও তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হবে ডিসিদের।
এবারের সম্মেলনে ডিসিদের দেশের শতভাগ সম্পদ জনকল্যাণের ব্যবহারের বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে সরকারের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সচেতন থেকে এ সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর উপকারিতা সম্পর্কে জনসাধারণকে জানানোরও নির্দেশনা দেবেন। পাশাপাশি এসব উন্নয়ন কজে ফসলি জমি যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেবেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে রিপোর্ট নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান মূল্যায়ন ব্যবস্থার বাইরে অন্য কোনও সংস্থার কাছ থেকে প্রতিবেদন বা ইনফরমেশন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি চাইবেন ডিসিরা। তাদের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্মেলন উদ্বোধনের পর মুক্ত আলোচনায় মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে শুনবেন ও নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া সম্মেলনে বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়াও তার কাছ থেকে দিক-নির্দেশনা নেবেন ডিসিরা।
ডিসি সম্মেলন চলার সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব, সচিবরা বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থিত থেকে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের দিক-নির্দেশনা দেবেন। কর্ম-অধিবেশনগুলো হবে সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে। কার্য অধিবেশনগুলোয সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
সূত জানায়, সরকারি সেবা নেওয়ায় ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ যেন কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেওয়া হবে ডিসিদের। এছাড়া, তৃণমূল-পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।
অতীতের মতো এবারের ডিসি সম্মেলনেও সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, গ্রামের মুরব্বি, নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী, নারী সংগঠক, আনসার-ভিডিপি, গ্রাম পুলিশ, এনজিওকর্মীসহ সমাজের সবাইকে সম্পৃক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, ডিসিরা মনে করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হওয়ার পর আলামত হিসেবে মাদকদ্রব্য পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হয়। এতে বিচার কার্য বিলম্বিত হয়। তাই সমাজকে মাদকমুক্ত করতে, এ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে এসব মামলার আলামত দ্রুত পেতে বিভাগীয় শহরে স্বয়ংসম্পূর্ণ মাদকদ্রব্য টেস্টিং ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রস্তাব জমা দিয়েছেন ডিসিরা। এবারের সম্মেলনে ডিসিরা এর সুরাহা চাইবেন বলে জানা গেছে।
ডিসি সম্মেলনকে সামনে রেখে গত দুই দিন ধরে প্রস্তুতি বৈঠক করছে এই বিভাগ। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ১৪ জুলাই সম্মেলন উদ্বোধনের পর ডিসিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন। ১৫ জুলাই সোমবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে টানা ছয়টি কার্য-অধিবেশনে ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ডিসিরা। এরপর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বঙ্গভবনে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার তৃতীয় দিন টানা ৫টি অধিবেশনে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওইদিন বিকেলেই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত আছে। ১৭ জুলাই বুধবার চতুর্থ দিনের জন্য নির্ধারিত ৮টি কার্য অধিবেশনে ১৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সম্মেলনের শেষ দিনে (৫ম দিনে) ৪টি অধিবেশনে ৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বৈঠক নির্ধারিত আছে। এদিন বিকেলেই জাতীয় সংসদে স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ডিসিদের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার ও জনগণের মধ্যে সরাসরি সেতুবন্ধন ঘটায় জেলাপ্রশাসন। জেলাপ্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক বা ডিসিরাই সরকারের সঙ্গে জনগণের সেতুবন্ধনের মূল দায়িত্ব পালন করেন। মাঠ প্রশাসনকে চাঙ্গা রাখতে ডিসিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে গতিশীলতা বাড়াতে ও তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের নীতি ও দর্শনের বাস্তবায়ন ও তা জনগনের কাছে পৌঁছে দিতে ডিসিরা সরাসরি কাজ করেন। তাই সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সরাসরি মতবিনিময় ও প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিতেই প্রতি বছরের মতো এবারও জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আয়োজন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জাতীয় সংসদের ১১তম সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠনের পর এটিই প্রথম ডিসি সম্মেলন।
এ বিষয়ে জানতে একাধিক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, অনেকেই এবার প্রথমবারের মতো ডিসি সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। তবে তারা তাদের পূর্বসূরিদের কাছে থেকে এ সম্মেলনের বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। তবে তা একান্তই সরকারের অভ্যন্তরীণ ও গোপনীয় বিষয়।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম বলনে, ডিসি সম্মেলনের সব কিছুই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন বাকি শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। ১৪ জুলাই রবিবার এ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে বাকি সব বিষয়গুলো সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সমাজের প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকারের নেওয়া বিশেষ পদক্ষেপগুলো কতটুক বাস্তবায়ন হলো বা হচ্ছে, তা তদারকির প্রতি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হবে। থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০ উদ্যোগের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে।
জানা গেছে, এবারও মাদকের বরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান ও এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি হচ্ছে জিরো টলারেন্স। কোনও ছাড় নয়, এই নীতিতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা থাকবে ডিসি সম্মেলনে। তবে কোনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মাদকের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোসহ কঠোর হওয়ার নর্দেশনা থাকবে সরকারের।