দেশের খবর: ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের শুনানিতে আইনজীবী বলেছেন, মাই লর্ড, উত্তরে ওষুধ দিলে মশা দক্ষিণে যায়, দক্ষিণে দিলে উত্তরে যায়। এ কারণে মশা নিধন সম্ভব হয়নি। তবে একযোগে যৌথ অভিযানের মাধ্যমে আমরা মশা নিধন করব।
আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ নিয়ে শুনানিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আইনজীবী এম সাইদ আহমদ রাজা এসব কথা বলেন।
এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শরীফ আহমেদ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন আদালতের সামনে একটি বেঞ্চে বসা ছিলেন।
আদালতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষে আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু ও দক্ষিণের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান শুনানি করেন।
ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন জ্বরের বাহক এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসে বিদেশ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ আনার প্রক্রিয়া জানানোর শুনানি দুপুর আড়াইটা থেকে শুরু হয়। শুনানিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, মাই লর্ড, আমাদের কাছে যে ওষুধ রয়েছে; তা সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছিল, এটি দিয়ে মশা নিধন সম্ভব। এখন নতুন ওষুধ আমদানি করতে হলে এক মাস সময় লাগবে। চীন থেকে এসব আমদানি করা হয়। এ মুহূর্তে দ্রুত সময়ে মশা নিধনে নতুন ওষুধ আনা সম্ভব নয়। আমাদের কিছু দিনের জন্য সময় দিন। এ সময়ের মধ্যে আমাদের কাছে থাকা বর্তমান ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে মশা নিধনের চেষ্টা করব। কেননা মশা নিধনে বিদেশ থেকে ওষুধ আনতে এক মাসের মতো সময় প্রয়োজন ।
এ সময় আদালত বলেন, আপনারা এত দিন কী করেছেন? এত দিন ভালোভাবে পদক্ষেপ নেননি কেন?
জবাবে আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, এত দিন যৌথ অভিযান হয়নি। এক ওয়ার্ডে ছিটানোর পর আবার অন্য ওয়ার্ডে ছিটানো হয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে ওষুধ ছিটানোর কারণে মশা নিধন সম্ভব হয়নি। উত্তরে ওষুধ দিলে মশা দক্ষিণে যায় আবার দক্ষিণে ওষুধ দিলে মশা উত্তরে যায়। এতে করে মশা নিধন সম্ভব হয়নি। দুই সিটি করপোরেশন যৌথভাবে সমন্বয় করে পুরো ঢাকা শহরে একই সময়ে মশা নিধনে অভিযান চালাবে।
এ সময় আদালত বলেন, আপনি এটা কী বলেন? দক্ষিণ সিটিতে ওষুধ দিলে মশা উত্তর সিটিতে যায়!
জবাবে আইনজীবী বলেন, বাতাসের সাহায্যে মশা এখান থেকে ওখানে উড়ে চলে যায়। এ জন্য আমরা ডোজ বাড়িয়ে দেব। এখন পাঁচ-ছয়টি করে ডোজ দেব। তবে বেশি ডোজ দিলে একটু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। এ ওষুধ বেশি ছিটালে ইঁদুরসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী পোকমাকড় মারা যায়।
জবাবে আদালত বলেন, আপনারা ইঁদুর মারা যাবে সেটা নিয়ে চিন্তা করেন! অথচ শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা নিয়ে আপনাদের মাথা ব্যথা নেই।
আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, মাই লর্ড, ২০০৩-২০১৫ সালে ওষুধ অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যরক্ষাকারী অনেক পোকামাকড় মারা যায়। এতে অনেক লেখালেখি ও কথা হয়েছিল।
জবাবে আদালত বলেন, সারা দেশে মশা একপক্ষ আর নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ অপরপক্ষ। আপনাদের অবহেলা সুস্পষ্ট বিদ্যামান।
এর জবাবে আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা আদালতের উদ্দেশে বলেন, সারা বিশ্বে এ সমস্যা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ বছর অতি বৃষ্টি, অতি গরম হচ্ছে; যা মশা উৎপাদনে সহায়তা করছে। দুই সিটি কপোরেশন সমন্বয় করে ডোজ বাড়িয়ে ওষুধ ছিটালে মশার সমস্যা কমে আসবে।
এ সময় আদালত আইনজীবীর কাছে জানতে চান, মশার ওষুধ যখন কার্যকর হচ্ছে না, তখন নতুন ওষুধ আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন না কেন?
জবাবে আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, ঢাকা সেনানিবাসে কিন্তু কোনো মশার সমস্যা নেই। তারা এই ওষুধ ব্যবহার করছে। তারা ডোজ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এখানে একযোগে করলে আশা করছি মশা নিধন সম্ভব হবে।
এ সময় আদালত বলেন, সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রী স্বীকার করেছেন, এই ওষুধে কাজ হচ্ছে না। এত দিন তো কেউ স্বীকারই করেননি। গত বছর তো ওষুধ কার্যকর হয়েছিল। গত বছর ওষুধ দিলে সেটার ঝাঁজ নাকে লাগত। এবারের ওষুধ তো তেমন কিছুই মনে হয় না।
জবাবে আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, মাই লর্ড, গত বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের দেশে অতি গরম এবং অতিবৃষ্টি হচ্ছে। মশা উৎপাদনের সুযোগ বেশি হচ্ছে। এই ওষুধ দিয়ে থাইল্যান্ড মশা নিধন করছে। তাদের ওখানে কোনো মহামারী বা ডেঙ্গু নেই।
জবাবে আদালত বলেন, আপনারা যে কোম্পানি থেকে ওষুধ আমদানি করেন তাদের বলেন, আমাদের দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী যেন ওষুধ তৈরি করা হয়।
জবাবে আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা আবারও বলেন, ডোজ বাড়িয়ে পাঁচ-ছয়বার দিলে মশা নিধন হয়ে যাবে। তবে ইঁদুরসহ পোকামাকড় মারা যাবে।
জবাবে আদালত আবারও বলেন, ইঁদুর মারা গেলে কী হবে? আগে তো মানুষ বাঁচাতে হবে।
এ সময় ঢাকা উত্তরের পক্ষে আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, মাই লর্ড, আমার বাচ্চাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ দিন হাসপাতালে ছিল। তবে এখানে যৌথ অভিযান চালালে দ্রুত সময়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
জবাবে আদালত বলেন, আপনারা তো এখানে এসে বলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো এখানে এসে বলার সুযোগ পাচ্ছে না।
জবাবে তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, ডোজ বাড়িয়ে দিলে এ ওষুধ কাজ করবে। কারণ এক ডোজ দিলে মশা অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। মরে না। তাই ওষুধ বাড়িয়ে দিলে মশা মারা যাবে।
এ সময় আদালত বলেন, আমাদের কথা হলো ওষুধ কাজ করে না। কেননা সেটা সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী মহোদয়ও বলেছেন, ওষুধ কাজ করে না। আর আপনারা বলছেন ওষুধ কাজ করছে?
জবাবে আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু বলেন, এটা নিয়ে সিটি কপোরেশন এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সিটি কপোরেশন। কিন্তু যখন মহামারি আকার ধারণ করে তখন সেটার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
জবাবে আদালত বলেন, ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করল আর আপনারা সেটি জানালেন না, স্বীকারও করলেন না।
আইনজীবী এম সাঈদ আহমদ রাজা বলেন, আইসিডিডিআরবির গবেষক শফিউল আলম বলেছেন, এ ওষুধ দিয়ে মশা নিধন সম্ভব। এ কারণে সিটি কপোরেশন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তিন দিন সময় চাই। এ তিন দিনে বেশি করে ফায়ারিং করে আমরা রিপোর্ট দাখিল করব আাদলতের কাছে।
পরে আদালত বলেন, ‘গুলি একবার করবেন, না তিনবার করবেন, তা জানি না। আমরা চাই মশা মরুক।’
পরে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কপোরেশনকে চার দিনের মধ্যে যৌথ অভিযান চালাতে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে আদালত দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
আগামী মঙ্গলবার কম্বিং অপারেশনের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। ওই দিন এই মামলার পরবর্তী আদেশ দেবেন আদালত।
এর আগে আদালতের তলবে হাজির হওয়া ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুনের বক্তব্য শোনেন হাইকোর্ট।
গত ২২ জুলাই আদালতের আদেশ সত্ত্বেও এডিস মশা নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেন হাইকোর্ট।
গত ১৪ জুলাই এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াসহ একই ধরনের অন্যান্য রোগের বিস্তার রোধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতেও বিবাদীদের বলা হয়।