দেশের খবর: ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক এক করে দেশের ৬৪ জেলায়ই ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। প্রথমে রাজধানীকেন্দ্রিক প্রকোপ দেখা যায়। এরপর ঢাকার আশপাশের জেলা ও সিটি করপোরেশনে ছড়ায়। গত সপ্তাহে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর আসতে থাকে। ধাপে ধাপে তা ছড়িয়ে জেলা ও উপজেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও আক্রান্তের দু-একটি খবর আসছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার দেশের ৬১ জেলা থেকে আক্রান্তের খবর এসেছিল। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে সেখানে নতুন করে জয়পুরহাটে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্য নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী ময়মনসিংহ, বরগুনা ও নেত্রকোনা জেলায়ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহে ১৫৩ জন, নেত্রকোনায় ২ জন, বরগুনায় ২২ জন আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় এই তিন জেলার নাম নেই। ইতিমধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে। গতকাল নতুন করে ১ এক হাজার ৪৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫৩ জনের। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৮ জন।
এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একজন পরিচালক বলেছেন, এডিস মশার প্রজননস্থলগুলো ধ্বংসে সফলতা না এলে এই রোগের প্রকোপ আরও বাড়বে। অপরদিকে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা যাদের দায়িত্ব সেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কেনা মশা মারার ওষুধ কাজ করছে না। আবার নতুন করেও তারা ওষুধ কিনছে না। সর্বোচ্চ আদালত জানতে চেয়েছেন কবে তারা মশার কার্যকরী ওষুধ কিনবে। আবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই ডেঙ্গু দুর্যোগের মধ্যে তিনি সপরিবারে মালয়েশিয়ায় গেছেন। এটা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। অবশ্য গতকাল রাতেই তার ফেরার কথা। আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় তিনি সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানানো হয়েছে। একদিকে রোগের প্রকোপ বাড়ছে, অপরদিকে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রকোপ বৃদ্ধির শঙ্কা :গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, এডিস মশার প্রজননস্থলগুলো ধ্বংসে সফলতা না এলে এই রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে।
মশার প্রজননস্থল নির্মূলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে পরিচালক বলেন, আমরা সবাই মিলে জোরেশোরে অ্যাট সোর্স মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সোর্স রিডাকশনে সফল হলে ডেঙ্গু হ্রাস করতে পারব। কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যাবে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর প্রভাব থাকে। পিক টাইম সেপ্টেম্বরে। এরপর আস্তে আস্তে কমে আসে। সুতরাং এখন একটি উপায়, সেটি হলো উৎস ধ্বংস করা। যত রকম ওষুধই ব্যবহার করা হোক না কেন সোর্স রিডাকশন না হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
ডেঙ্গু রোগীর পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় রি-এজেন্টের সংকটের কথা তুলে ধরে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে সংক্রামক ব্যাধি শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, জরুরিভিত্তিতে ৫০ হাজার এনএসওয়ান কিট আমদানি করা হচ্ছে। সেই কিট এলেই সংকট দূর হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পরিচালক বলেন, এসব কিট দেশে তৈরি হয় না। তাই আমদানি করতে একটু সময় লাগবে। তবে এক সপ্তাহের বেশি লাগবে না। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এক লাখ কিট দেবে। এসব কিটও বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষায় ব্যবহূত আরডিটি কিট ইতিমধ্যে সব জেলায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসার গাইডলাইন পাঠানো হয়েছে।
ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চারশ’ দল রাজধানীর দুই লাখ শিক্ষার্থীর কাছে যাবে। ডেঙ্গুর উৎসস্থল কীভাবে নির্মূল করা যায়, তারা সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেবে। শিক্ষার্থীরা বাসায় গিয়ে যেন তা প্রয়োগ করতে পারে।
আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক হিসাব নেই : ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গতকাল পর্যন্ত ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার সারাদেশে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মাত্র আটজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নতুন এক হাজার ৪৭৭ রোগী ভর্তি হয়েছেন। চলতি মাসে এযাবৎকালের মধ্যে এক মাসে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৯৯৬ জন আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড গড়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ১৭ হাজার ১৮৩ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু- এই দুই হিসাব নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানোর তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার অনেক তফাত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর সরকারি ১৩ ও বেসরকারি ৩৬ হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তালিকা ধরে আক্রান্তের হিসাব করছে। কিন্তু রাজধানীর বাইরে আরও সাড়ে তিনশ’ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক আছে, সেগুলোতেও কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। অথচ তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় নেই। এ ছাড়া বিভাগ ও জেলায় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের তালিকা পাঠানো হচ্ছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা নেওয়া আক্রান্তের কোনো হিসাব নেই।
ঢাকা বিভাগ :ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলায় ১৭৪ জন, গাজীপুরে ১২০, গোপালগঞ্জে ১০, মাদারীপুরে ২৪, মানিকগঞ্জে ৩২, নরসিংদীতে ২৬, রাজবাড়ীতে ৩৭, শরীয়তপুরে ১২, টাঙ্গাইলে ৫১, মুন্সীগঞ্জে ২৭, কিশোরগঞ্জে ১০৩, নারায়ণগঞ্জে ২৪ এবং ফরিদপুরে ২ জনসহ মোট ৬৪২ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিভাগ :চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলায় ২২৬ জন, ফেনীতে ৮৫, কুমিল্লায় ৬৫, চাঁদপুরে ১০২, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৬, লক্ষ্মীপুরে ৩৩, নোয়াখালীতে ৪১, কক্সবাজারে ১৭, খাগড়াছড়িতে ১০, রাঙামাটিতে ৩ এবং বান্দরবানে ১ জনসহ মোট ৬০৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
খুলনা বিভাগ :খুলনা জেলায় ১৮০ জন, কুষ্টিয়ায় ৭২ জন, মাগুরায় ৮ জন, নড়াইলে ১০ জন, যশোরে ৯৮ জন, ঝিনাইদহে ২৬ জন, বাগেরহাটে ৮ জন, সাতক্ষীরায় ২৩ জন, চুয়াডাঙ্গায় ৮ জন ও মেহেরপুরে ৩ জনসহ মোট ৪৩৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
রাজশাহী বিভাগ :রাজশাহী জেলায় ৮১ জন, বগুড়ায় ১১৬ জন, পাবনায় ৪৯ জন, সিরাজগঞ্জে ১৯ জন, নওগাঁয় ১০ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৮ জন, নাটোরে ৫ জন ও জয়পুরহাটে ১ জনসহ মোট ২৯৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
রংপুর বিভাগ :রংপুর জেলায় ৭৯ জন, লালমনিরহাটে ৩ জন, কুড়িগ্রামে ৫ জন, গাইবান্ধায় ৬ জন, নীলফামারীতে ৮ জন, দিনাজপুরে ৩৩ জন, পঞ্চগড়ে ২ জন ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১২ জনসহ মোট ১৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
বরিশাল বিভাগ :বরিশাল জেলায় ১০১ জন, পটুয়াখালীতে ১৬ জন, ভোলায় ৭ জন, পিরোজপুরে ৩ জন ও ঝালকাঠিতে ১ জনসহ মোট ১২৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
সিলেট বিভাগ :সিলেট জেলায় ১৬৮ জন, সুনামগঞ্জে ৭ জন, হবিগঞ্জে ১৩ জন, মৌলভীবাজারে ২৬ জনসহ মোট ১৩৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
ময়মনসিংহ বিভাগ :ময়মনসিংহে মেডিকেল কলেজে ২০৩ জন, জামালপুরে ৪৭ জন এবং শেরপুরে ১৪ জনসহ মোট ২৫৬ আক্রান্ত হয়েছেন।সূত্র: সমকাল