নিজস্ব প্রতিনিধি : দেড়শ’ কিলোমিটারের বেতনা নদী এখন ছয় কিলোমিটারে এসে কোনোমতে টিকে রয়েছে। ৩০ কিলোমিটারের মরিচ্চাপ নদী কপোতাক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার কিলোমিটারে এসে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সাতক্ষীরার এই দুই নদী এখন বদ্ধ জলাধারে পরিণত হয়েছে। জেলার পলি জমা এসব নদ-নদীর দুই তীরে বসবাসকারী ২০ লাখ মানুষ গত তিন দশক ধরে জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছেন। তারা পরিবেশ ও তাদের জীবিকা হারিয়ে ফেলছেন।
সাতক্ষীরায় এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব ভয়ংকর তথ্য তুলে ধরে বক্তারা বলেন, যথাযথ নদী ব্যবস্থাপনা না থাকায় জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের প্রধান উপজীব্য ধান মাছ পশুপালন এবং বসতিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন ‘বিপন্ন নদী, বিপন্ন জনজীবন’ এ কথা উল্লেখ করে গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয় আগামিতে এ অঞ্চলে স্বাভাবিক বসতি থাকবে কি-না তা নিয়ে শংকিত জনগণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ পশ্চিমের এ অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী এমনকি পরিত্যক্তও হতে পারে।
রবিবার সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শহীদ স ম আলাউদ্দিন মিলনায়তনে বেসরকারি সংস্থা উত্তরণ, পানি কমিটি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব ও প্রগতি’র যৌথ উদ্যোগে ‘জলাবদ্ধতা দুরীকরণে বেতনা ও মরিচ্চাপ অববাহিকার নদী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পানি কমিটি সম্পাদক গবেষক অধ্যাপক হাসেম আলি ফকির।
গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সভার সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ। বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন উত্তরণ পরিচালক শহিদুল ইসলাম।
প্রগতি’র প্রধান নির্বাহী অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহীর সঞ্চালনায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর ইসলাম, কেন্দ্রিয় পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমেদ বাপী, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনিসুর রহিম।
মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি, সেতু-বাংলাদেশ এর পরিচালক আবুল হোসেন, সুশীলনের উপ-পরিচালক জিএম মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন, প্রকৌশলী আবেদুর রহমান, সাংবাদিক ইয়ারব হোসেন ও গোলাম সরোয়ার, আলি নুর খান বাবুল, মো. নুরুল ইসলাম, আবদুর রব বাবু, প্রেরণার পরিচালক শম্পা গোস্বামী, বেতনা নদী বাঁচাও কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা প্রমূখ।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী, প্রমুখ।
বৈঠকে জানানো হয় জেলার সব নদ-নদীতে এখনও রয়েছে হাজার হাজার নেট পাটা। এসব নদীর পাড়েই গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। দখলকৃত নদী চরে নোনা পািন তুলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে এলাকায় পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। কৃষি ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা মরে যাচ্ছে। নদীর যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত স্লুইস গেট স্থাপন করে পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করা হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন মরিচ্চাপ নদীর পানি এখন আর কপোতাক্ষে প্রবাহিত হয় না। মানুষ পায়ে হেঁটে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী পার হয়। ইছামতির শাখা নদী কাকশিয়ালি, সাপমারা, লাবণ্যবতীও মরণাপন্ন অবস্থায় চলে গেছে। এসব নদী তীরের মানুষ ভুগছে জলাবদ্ধতার যন্ত্রণায়। তারা হারিয়েছেন তাদের আদি পেশা , কুটির শিল্প, গবাদি পশুপালন ও বনায়ন। তাদের বাড়িঘর বারবার ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। উৎপাদনহীনতার কারণে খাদ্য নিরাপত্তার মুখেও পড়ছেন তারা।
গোলটেবিল বৈঠকে বলা হয় সুন্দরবনের নদ নদী ভরাট হয়ে আসছে। ফলে অতিমাত্রার বৃষ্টি ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা আছড়ে পড়ছে উপকূল ভাগের নদী খাল জনপদে। উপকূলীয় বাঁধ বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভাঙ্গন, দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। বৈশি^ক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবন লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। গত তিন দশক ধরে তারা এসব যন্ত্রণায় ভুগছেন।
বক্তারা বলেন, নদী খননই এখন প্রধান কাজ। কেবল খনন কাজই যথেষ্ট নয় জানিয়ে তারা বলেন একই সাথে জোয়ারাধার (টিআরএম)সৃষ্টি করতে না পারলে খনন ফলপ্রসূ হবে না। বেতনা নদীতে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়ন করে মরিচ্চাপ নদীকে টিআরএমএর উপযোগী করে তোলা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তারা আশাশুনির বুধহাটায় নোয়াপাড়া বিল অথবা গাবতলা স্লুইসগেট এলাকায় টিআরএম এর সুপারিশ করেন। সুপারিশে আরও বলা হয় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসরোধে উপকূলীয় বাঁধ আরও উঁচু টেকসই এবং মজবুত করতে হবে। বেতনা নদীর আশাশুনির বুধহাটা থেকে সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা এবং আশাশুনি সদর থেকে বালিথার ত্রিমোহিনী পর্যন্ত মরিচ্চাপ নদী খননের তাগিদ দিয়ে তারা বলেন তার আগে নদী পাগেড়র অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। তারা আন্ত:নদী খালে সংযোগ স্থাপনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।
জেলার সব নদ নদী-খাল পুনরুদ্ধার করে সচল ও স্বাভাবিক করতে পারলেই সমস্যার হতে পারে জানিয়ে তারা বলেন এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হবে। পরিবেশ প্রতিবেশ জীবন জীবিকা রক্ষায় জনগণকে আরও সচেতন হবার আহবান জানানো হয়।
সাতক্ষীরা জেলার সকল নদী-খাল দখলমুক্ত ও খননের দাবি
পূর্ববর্তী পোস্ট