দেশের খবর: ১০ দফা দাবির মধ্যে যেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বুয়েট। এই দাবিতে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা শেষে কোনো সমাধান না হওয়ায় আবারও বিক্ষোভে নেমেছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।
‘খুনিদের ফাঁসি চাই’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘ফাঁসি ছাড়া যাব না’ , ‘খুনিদের স্থায়ী বহিষ্কার চাই’, ‘শিক্ষা-সন্ত্রাস একসাথে চলে না’; ইত্যাদি স্লোগানে আবারও আন্দোলন শুরু করেছে বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারীরা বলছে, ‘আমাদের ২ নং দাবি ছিলো, সকল অপরাধীকে স্থায়ী বহিষ্কার। অথচ সাময়িকভাবে শুধুমাত্র ১৯ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অবিলম্বে সিন্ডিকেট ডেকে সকল খুনীকে স্থায়ীভাবে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, পূর্বের বিভিন্ন সময়ের মতো খুনীরা আদালতের রায় নিয়ে আবারও ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে।’
‘আমাদের ৩ নং দাবি ছিলো, আবরার হত্যা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করার। যাতে ৯০ দিনের মধ্যে আদালতের রায় পাওয়া যায়। অথচ এই দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। Justice delayed is justice denied.’
‘আমাদের ১ নং দাবি (খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে) পূরণের বিষয়টি বিশেষভাবে নির্ভর করছে এই দুইটি দাবিপূরণের উপর।’
ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম।
শুক্রবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে এ আলোচনা সভা শুরু হয়।
আলোচনা সভায় আগামী ১৪ অক্টোবর বুয়েটের অনুষ্ঠিতব্য প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করার দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। ১৪ অক্টোবর যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে রয়েছেন শিক্ষকরা। অপরদিকে ওইদিন পরীক্ষা স্থগিত করে পেছানোর দাবি তুলেন আবরার হত্যায় ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এই দাবিতে একমত না হতে পারেনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা শেষে শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় রাত সাড়ে নয়টায়। এরপর থেকেই আবারো বিক্ষোভ শুরু করেন।
এর আগে রাত ৮টার দিকে বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যের আলোচনা শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির জবাব দেন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। আবরারের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং মামলার খরচ বুয়েট কর্তৃপক্ষ বহন করবে। বিচারকাজ দ্রুত শেষ করতে সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে। বুয়েটে র্যাগিং বন্ধ হবে।
উপাচার্যের আশ্বাস শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা আশ্বাস এবং মন ভুলানো কথা চাই না। আমরা একই দাবি বারবার জানিয়ে আসছি এবং আপনারাও একই কথা বলে আসছেন। কিন্তু এই সাইকেল আর কতদূর চালাতে হবে। আমরা দাবির বাস্তবায়ন এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই।
এছাড়া দাবি বাস্তবায়নের পর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বলছেন, যে দাবিগুলো পূরণ করা সম্ভব এই দাবিগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এবং পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
উপাচার্য আলোচনা সভা থেকে ওঠে যাওয়ার আগে বলেন, ‘আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উঠছি। শেষবারের মতো অনুরোধ করছি, আমাদের সম্মান ধুলায় লুটাতে দিও না। ভর্তি পরীক্ষা হতে দাও। অফিসগুলো খুলে দাও।’
কিন্তু শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের আহবানে কোনো সাড়া দেননি। তাদের দাবি, ১০ দফা দাবি বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম চলবে। এর আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় তারা।
শিক্ষার্থীদের ১০ দফা গুলো হলো:
১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে: সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে শনাক্তকারী খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা সবাইকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ বিকাল পাঁচটার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. মামলা চলাকালে সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। এ মর্মে অফিশিয়াল নোটিশ ১১ তারিখ পাঁচটার মধ্যে প্রদান করতে হবে।
৪. আবরার হত্যায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করতে বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সব প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে।
৫. অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিশিয়াল নোটিশ দিতে হবে।
৬. বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েট হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়েছে। জুনিয়র মোস্ট ব্যাচকে সব সময় ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক জোর করে রাজনৈতিক মিটিং–মিছিলে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেকোনো সময় যেকোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের জোর প্রদর্শনপূর্বক হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এমন কর্মকাণ্ডে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ। তাই আগামী ৭ দিনের মধ্যে (১৫ অক্টোবর) বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে আজ বেলা দুইটার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।
৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধে করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লা হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
৯. পূর্বের ঘটনা এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা যেকোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্ল্যাটফর্ম, কোনো সাইট বা ফর্ম থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে। পরবর্তী ১ তারিখের মধ্যে কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরে উইংয়ের দুপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ায় শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর, ২০১৯ তারিখ বিকেল পাঁচটার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে শেষেরটি এরই মধ্যে পূরণ হয়েছে। শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল খান গত বুধবারই পদত্যাগ করেছেন।