দেশের খবর: গ্যাস বেলুন ওড়ানোর শখ ছিল ওদের। ঘিরে ধরেছিল বেলুনওয়ালাকে। কিন্তু হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সব শেষ। বেলুন নয়, প্রাণটাই উড়ে গেছে পাঁচ শিশুর।
বুধবার রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কে বেলুনে গ্যাস ভরে বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। রং-বেরঙের বেলুনের আকর্ষণে তাকে ঘিরে ভিড় করছিল শিশুর দল। হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়।
মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ঘটনাস্থল। ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকে কয়েক শিশুর নিথর দেহ। বিস্ফোরণে কারও হাত, কারও বা পা উড়ে যায়। দ্রুত তাদের উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে পাঁচ শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকের এ ঘটনায় আহত হন আরও অন্তত ১৮ জন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নিহতদের মধ্যে এক শিশুর নাম ফরহাদ হোসেন রুবেল (১১)। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে স্থানীয় কামরুলের বস্তিতে থাকত। বাকি চারজনের নাম রমজান (৮), নূপুর (১০), শাহিন (৭) ও জান্নাত (১৪)। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ূয়া বলেন, রূপনগরের ঘটনায় ১০ জনকে এই হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে পাঁচজন এখানে আসার আগেই মারা গেছে। বাকিদের মধ্যে দুজনকে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গুরুতর আহত তিনজনকে পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক)।
এদিকে ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, আহত ১০ শিশুসহ ১৪ জন সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্তত দু’জনের অবস্থা সংকটাপন্ন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সড়কের পূর্ব প্রান্তে চলন্তিকা বস্তিঘেঁষা এলাকায় দু-একদিন পরপর ভ্যান নিয়ে গিয়ে বেলুন বিক্রি করেন এক ব্যক্তি। স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের অনেকে টাকার বদলে কুড়িয়ে পাওয়া বোতলসহ বাতিল সামগ্রী জমা দিয়েও বেলুন নিত তার কাছ থেকে। বুধবারও তাকে দেখে এটা-সেটা নিয়ে যায় শিশুরা।
এ ঘটনায় গুরুতর আহত নয় বছরের শিশু মরিয়ম জানায়, বেলুন পাওয়ার জন্য সে কুড়িয়ে পাওয়া বোতল জমা দিয়েছিল বিক্রেতার কাছে। তখন গ্যাস না থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে বলেন বিক্রেতা। এর মধ্যে তিনি এক শিশুকে পাঠান পানি আনতে। পানি আনার পর তিনি সিলিন্ডারে খুটখাট করতে থাকেন। এর মধ্যেই ঘটে বিস্ফোরণ। মরিয়মসহ অন্যরা ছিটকে পড়ে দূরে। বিস্ফোরণের আগুনে ঝলসে যায় তারা।
প্রত্যক্ষদর্শী আরেক শিশু মিরাজুল ইসলাম জানায়, সে ও প্রতিবেশী এক শিশু বেলুন কিনতে গিয়েছিল। বেলুন দিতে একটু দেরি হবে জানিয়ে তাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন বেলুন বিক্রেতা। এর মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। তার হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত লাগে।
প্রত্যক্ষদর্শী তাসলিমা বেগম বলেন, ‘পাশেই আমার বাসা। শব্দ শুইনা আমি ছুইটা যাই। গিয়া দেখি খুবই খারাপ অবস্থা। দুইটা বাচ্চার হাত নাই, একটা বাচ্চার নাড়িভুঁড়ি বাইর হয়ে আসছে। একজন তো ওই অবস্থায় দৌড়াইয়া দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতেছিল। কিন্তু খানিক গিয়া পইড়া গেছে। কয়েকজন পুইড়া কালো হইয়া গেছে। এরপর লোকজন সবাই মিল্যা তাগো হাসপাতালে নিয়া আসি।’
আহতদের মধ্যে জান্নাত নামে এক নারী রয়েছেন। তার স্বামী নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বাজার করে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। রূপনগরের ১১ নম্বর সড়কের কাছে যেতেই ওই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে জান্নাতের ডান হাতের একাংশ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণে আহতদের কিছুক্ষণ আগে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কাচের বোতল, কাঠের টুকরো ও স্যান্ডেলসহ অন্যান্য জিনিস।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা এক ছবিতে দেখা যায়, বিস্ফোরণ ও আগুনে ক্ষতবিক্ষত তিন শিশুর লাশ পড়ে আছে। তাদের দু’জনের হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। দেহের পাশেই কুড়িয়ে রাখা হয়েছে বিচ্ছিন্ন হাতের টুকরো।
বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তাদের অন্তত চারজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন জানান, আহত ১৬ জনের চিকিৎসা চলছে। তাদের অধিকাংশই শিশু। এর মধ্যে চার-পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর।
ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের মধ্যে রয়েছে- মিম (৮), সিয়াম (১১), মোস্তাকিন (৮), অজুফা (৭), তানিয়া (৭), জামিলা (৮), সোহেল (২৫), জুয়েল (২৯), জান্নাত (২৫), নেহা (৮), অর্ণব (১০), জনি (৯), মোরসালিনা (১০), অজ্ঞাত (৫) ও রাকিব (১২)।
সোহওরায়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সোনিয়া ইসলাম জানান, সিরাজুল ও রাফি নামে দুই শিশু সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছে।
এদিকে আহতদের দেখতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। এ সময় তিনি বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছে।
আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অবাধে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন পেয়ে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স অ্যাসোসিয়েশনের লোকজনও ঘটনাস্থলে যান। তারা হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে সহায়তা করেন।