দেবহাটা ব্যুরো : ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর, দেবহাটা মুক্ত দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা এই দিনে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো, উড়েছিলো বিজয়ের পতাকা। পাক হানাদার মুক্ত হয়ে সমগ্র এলাকার মানুষের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিলো। এই দিনে দেবহাটার মানুষ খুজে পেয়েছিল দীর্ঘদিনের যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ। মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সমগ্র দেবহাটা ছিল ৯ নং সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত। এই ৯ নং সেক্টরের আওতায় ৩ টি সাব-সেক্টর গঠন করা হয়। তার মধ্যে প্রথম সেক্টরটি ছিল শমসের নগর। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। দ্বিতীয়টি হেঙ্গলগজ্ঞ ও তৃতীয়টি ছিল টাকী। যার নেতৃত্বে ছিলেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টরের মধ্যে ৯ নং সেক্টরটি ছিল সর্ববৃহৎ। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের উদ্যোগেই ভারতের টাকীতে গড়ে তোলা হয় ৯ নং সেক্টর। সেজন্য তাকে ৯ নং সেক্টরের প্রতিষ্টাতা ও সাব সেক্টর কমান্ডারের খেতাব দেয়া হয়। সমগ্র দেবহাটা থানা ৯ নং সেক্টরের অধীনে ছিল। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। শাহজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বেই এই অঞ্চলের যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। তিনি দেশ মাতৃকার টানে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের প্রেরনা যুগিয়েছিলেন। তখন দেবহাটা এলাকার খানজিয়া ক্যাম্প, দেবহাটা ক্যাম্প, টাউনশ্রীপুর ক্যাম্প, সখিপুর ক্যাম্প, পারুলিয়া ক্যাম্প, কুলিয়া বাজার ও পুষ্পকাটি ইটের ভাটা সহ বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনারা ঘাঁটি গড়ে তোলে। দেবহাটা এলাকায় টাউনশ্রীপুর ফুটবল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এক রাজাকার পাক সেনাদের কাছে পৌছে দেয়। ফলে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার বুঝতে পেরে অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়। এছাড়া ভাতশালা সহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। ভাতশালা যুদ্ধের শেষের দিকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের মাথায় লাগে। সেখানেই তিনি নিহত হন। একপর্যায়ে টাউনশ্রীপুরের সেনা ঘাটির পতন হয়। তখন প্রধান সেনাপতি এম.এ জি ওসমানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ ও সেক্টর কমান্ডার এম.এ জলিল সকলে মিলে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। এখান থেকে পাক সেনারা যাওয়ার সময় শাহজাহান মাষ্টারের বাড়ি কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এরপরে অক্টোবর মাসে খান সেনারা খাঁনজিয়া ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারা যাওয়ার সময় ঐ এলাকায় এ.পি মাইন পুতে রেখে যায়। ঐ মাইনগুলো অপসারন করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব শহীদ হন। পরে পারুলিয়া, সখিপুর ও কুলিয়া সহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। তারা চলে যাওয়ার সময় বহু মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং পারুলিয়া ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়। এভাবে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয় ও ওঠে বিজয়ের পতাকা। সেই দিনটিকে স্মরন করে দেবহাটা উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়। দিবসটি যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে শুক্রবার সকাল ১০ টায় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে থেকে একটি র্যালী প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন শেষে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মিলনায়তনে দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজিয়া আফরীনের সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দেবহাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলহাজ¦ আব্দুল গনি। বিশেষ অতিথি ছিলেন যথাক্রমে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি ও দেবহাটা থানার ওসি (তদন্ত) উজ্জ্বল কুমার মৈত্র। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা অধীর কুমার গাইনের সঞ্চালনায় এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ¦ আব্দুল মাবুদ গাজী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ইয়াছিন আলী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দপ্তর কমান্ডার আব্দুর রউফ, অর্থ কমান্ডার সাবুর আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুস শাহাদাৎ নফর বিশ^াস, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক, দেবহাটা সদর ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী ইদ্রিস, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল হাই রকেট, সখিপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম, মরহুম ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাস্টারের পুত্র বাংলাদেশ বেতারের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ফারুক মাহবুবুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি আবু রাহান তিতু, দেবহাটা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর খায়রুল আলমসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ। শেষে অসহায় ও দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কম্বল বিতরন করা হয়।
৬ ডিসেম্বর দেবহাটা মুক্ত দিবস পালন
পূর্ববর্তী পোস্ট