বিশেষ ডেস্ক: সারা বিশ্বে গত ৩০ বছরে ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। এর ফলে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখ।
এখন এরকমই এক করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে চীনে, যা খুব দ্রুত চীনের বিভিন্ন শহরে তো বটেই, সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু কেন এতো দ্রুত ছড়াচ্ছে এই করোনাভাইরাস?
পৃথিবীতে এখন মানুষের সংখ্যা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্ব জনসংখ্যা বর্তমানে ৭৭০ কোটি। এই সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি মানুষ এখন একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি বসবাস করছে।
অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বাস করার অর্থই হলো জীবাণুর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া, যার ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখের সৃষ্টি হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে মানুষ থেকে মানুষে, তাদের হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে।
মানুষের দেহের বাইরে এই ভাইরাসটি খুব অল্প সময় বেঁচে থাকতে পারে। ফলে ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে হলে তাদেরকে কাছাকাছি থাকতে হবে।
ইবোলা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ২০১৪ সালে আর সেবার এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল রক্ত কিম্বা শরীর থেকে নির্গত অন্য কোন তরল পদার্থের মাধ্যমে। ফলে রক্ত দান ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
মানুষের ঘনবসতি
সব ভাইরাস কিন্তু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। এমনকি জিকা ভাইরাসও, যা মানুষের শরীরে আসে মশা থেকে, সেটাও লোকজন ঘনিষ্ঠ বসবাস করলে ছড়াতে পারে।
যেসব এলাকায় মানুষের ঘনবসতি, সেখানে জিকা ভাইরাস-বাহী মশা মানুষের রক্ত খেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাদের জন্মের বিস্তার ঘটে আদ্র, স্যাঁতসেঁতে ও উষ্ণ পরিবেশে।
২০০৭ সালের পর থেকে শহরাঞ্চলে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এরকম এলাকা পৃথিবীর মোট জমির মাত্র এক শতাংশ। কিন্তু এইটুকুন জায়গাতেই বাস করে ৪০০ কোটিরও বেশি মানুষ।
শুধু তাই নয়, লোকজন এখন এমন শহরের দিকে ছুটে যাচ্ছে যেগুলো এখনও বসবাসের জন্যে প্রস্তুত নয়।
ফলে অনেক মানুষের আশ্রয় হয় বস্তি এলাকায় যেখানে পরিষ্কার খাবার পানি নেই, পয়-নিষ্কাশন ব্যবস্থাও খুব খারাপ। ফলে এরকম পরিবেশে খুব দ্রুত রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
গণ-পরিবহন
এছাড়াও সংক্রামক ভাইরাস শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে পরিবহনের মাধ্যমে।
বিমান, রেল, গাড়িতে করে এখন ভাইরাস পৃথিবীর অর্ধেক দূরত্বও পাড়ি দিতে পারে একদিনেরও কম সময়ে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি পাওয়া গেছে কমপক্ষে ১৬টি দেশে।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বিমানে চলাচল করেছে ৪৫০ কোটি যাত্রী। কিন্তু মাত্র ১০ বছর আগেও তাদের সংখ্যা ছিল ২৪০ কোটি।
চীনে দ্রুত গতির যে ট্রেন চলে তার প্রধান একটি স্টেশন উহান। এই শহরটি থেকেই ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস।
তাছাড়াও এই ভাইরাসটি এমন সময়ে দেখা দিয়েছে যখন চীনের কোটি কোটি মানুষ তাদের নব বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় ছুটিতে সারা দেশে ভ্রমণ করছে।
চীনা নব বর্ষের সময় সাধারণত সারা দেশে ৩০০কোটি বারেরও বেশি ট্রেন চলাচল করে থাকে।
৫ থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ১৯১৮ সালে। ওই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটি পরিচিত স্প্যানিশ ফ্লু নামে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, মানুষ যখন ইউরোপের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাচ্ছিল, তখনই ওই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভাইরাসটি যখন ছড়াচ্ছিল তখন সৈন্যরা ফিরে যাচ্ছিল যার যার নিজেদের দেশে। একই সঙ্গে তারা সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসও।
এই ভাইরাস তারা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যেখানে তখনও ভাইরাস প্রতিরোধী কোন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছেও ওই ভাইরাসটি ছিল একেবারেই অচেনা ও নতুন।
ভাইরোলজিস্ট জন অক্সফোর্ডের একটি গবেষণা অনুসারে ওই ভাইরাসটির উৎস ছিল একটি ক্যাম্প, যেখান দিয়ে প্রতিদিন এক লাখের মতো সৈন্য অতিক্রম করেছে।
সেসময় বিমান চলাচলেরও তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু তারপরেও ওই ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ধারণা করা হয় ওই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে পাঁচ থেকে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
এই ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় নিয়েছিল ৬ থেকে ৯ মাস। আর বর্তমানে, যখন আমরা মাত্র একদিনেই সারা পৃথিবী ঘুরে আসতে পারি, সেখানে তো এই ভাইরাস আরো অনেক দ্রুত গতিতেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পশুপাখি ও মাংসের চাহিদা
ইবোলা, সার্স এবং এখনকার করোনাভাইরাস – এগুলো সবই জুনোটিক ভাইরাস। এগুলো প্রাণী থেকে ছড়িয়েছে মানব দেহে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এই ভাইরাসটি হয়তো সাপ থেকেই এসেছে।
আজকের দিনে যতো অসুখ আছে তার চারটির প্রায় তিনটিই হয় জুনোটিক ভাইরাসের কারণে।
সারা বিশ্বেই খাদ্য হিসেবে মাংসের চাহিদা বাড়ছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পশুপাখির চাষও।
ফ্লু ভাইরাস সাধারণত গৃহপালিত পশুপাখি থেকেই মানুষের দেহে ছড়ায়। ফলে মানুষের এখন আক্রান্ত পশুপাখির সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিও বেড়ে গেছে।
করোনাভাইরাস মানবদেহে এসেছে বন্যপ্রাণী থেকে। চীনে জনবহুল এলাকাতেও আছে এসব প্রাণীর বাজার। এ থেকেও বোঝা যায় চীনে এই ভাইরাসটি কীভাবে এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো।
এছাড়াও শহরের আকার বেড়ে যাওয়ায় লোকজন গ্রামীণ এলাকায় চলে আসায় তারা বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসছে বেশি। এরকম ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে লাসা জ্বর। গাছপালা কেটে মানুষ যখন সেখানে চাষাবাদ করছে, তখন সেখান থেকে ইঁদুর মানুষের বাড়িঘরে চলে আসছে এবং তারা তাদের সাথে করে নিয়ে আসছে লাসা জ্বর।
পৃথিবীর এক জায়গা এখন আরেক জায়গার সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত কিন্তু সারা পৃথিবীতে একসাথে কাজ করবে এরকম সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনও।
এই প্রকোপ ঠেকাতে ভাইরাসটি যেদেশে উৎপত্তি হয়েছে আমরা সেই দেশের সরকারের ওপরেই নির্ভর করি। তারা ব্যর্থ হলে সারা পৃথিবীর মানুষ ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
পশ্চিম আফ্রিকায় গিনি, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিয়ন যখন ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো তখনই সেটা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়লো।
পশ্চিম আফ্রিকাতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১,৩১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে সৌভাগ্য যে ওই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল তুলনামূলক ভাবে অনেক ধীর গতিতে। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাস, যা শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায়, সেগুলো অনেক বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
স্বাস্থ্যসেবা ও বিনিয়োগ
দরিদ্র এলাকাতে যেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খারাপ, সেখানে এটি দ্রুত ছড়াবে। শিক্ষা, সচেতনতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পয়-নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব হলে এই ঝুঁকি আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।
একই সাথে এসব দেশ থেকে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ লোকেরা অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
এছাড়াও যেসব রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে সেসব মোকাবেলায় কেউ তাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করতে চায় না।
যখন সোয়াইন ফ্লুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল তখন সারা বিশ্বেই এর ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছিল। কিন্তু ভাইরাসটি ততোটা মারাত্মক না হওয়ায় পরে এই উদ্যোগেরও সমালোচনা হয়েছে।
এসব ভাইরাস মোকাবেলায় ওষুধ তৈরির জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রযুক্তি থাকলেও ওষুধ কোম্পানিগুলো এতে বিনিয়োগ করে না। কারণ এসব ভাইরাসে যদি মাত্র কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয় তা থেকে এই কোম্পানিগুলো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে না।
আমরা জানি যে ভাইরাসের প্রকোপ ঘটবে কিন্তু আমরা জানতে পারি না যে কখন ও কোথায় এই প্রকোপ দেখা দেবে। এর ফলে কোথাও সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপের খবর আমাদের কাছে সবসময় বিস্ময় হিসেবেই আসে।
তবে সুখবর হচ্ছে, গবেষণায় দেখা গেছে, এখন রোগের প্রকোপ বেশি হলেও এতে অল্প সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে।
যখন দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, যেমনটা আমরা চীনে দেখছি, সাথে সাথে স্বাস্থ্য সেবাও উন্নত হচ্ছে।
কীভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও এড়িয়ে চলা যায় তার তথ্যও খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
বর্তমানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের মতো একটি দেশ ১,০০০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে তুলতে পারে মাত্র এক সপ্তাহে। ১৯১৮ সালে এটা ছিল কল্পনাতীত বিষয়। বিবিসিবাংলার প্রতিবেদন