আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রোহিঙ্গা গণহত্যার আলামত সংগ্রহ শুরু করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের লক্ষ্যে এই আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কবে নাগাদ এই বিচার শুরু হবে তা নিশ্চিত নয়। অপরাধ প্রমাণ করার মতো আলামত সংগ্রহ হলে শুরু হবে বিচার কাজ। তবে এই বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। অপরাধ প্রমাণ হলে তার সর্বোচ্চ সাজা আমৃত্যু কারাবাস।
আইসিসি’র একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে দলের প্রধান পাকিসো মচোচোকো মঙ্গলবার ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
তিনি আইসিসির প্রসিকিউটর দফতরের জুরিডিকশন, কো-অপারেশন কপ্লিমেন্টারিটি বিষয়ক পরিচালক। আইসিসি’র অধীনে বিচার শুরু হলে জাতিসংঘের আওতাভুক্ত দুটি আদালতে এ বিচার সম্পন্ন হবে। জাতিসংঘের অধীনে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু করেছে।
আইসিজে দুই রাষ্ট্রের বিরোধ নিষ্পত্তি করে; কোনো ব্যক্তির বিচার করে না। দ্য হেগে অবস্থিত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই মামলাটি দায়ের করে গাম্বিয়া। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠাকালে আইসিজে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু গণহত্যা নয়; দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোনো বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এই আদালত।
অপরদিকে ১৯৯৮ সালে রোম সংবিধির আওতায় আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয়। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে বিশেষায়িত এই আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বাংলাদেশ সই করলেও মিয়ানমার রোম সংবিধিতে সই করেনি। ফলে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার আইসিসিতে করা সম্ভব কিনা এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে পাকিসো মচোচোকো বলেন, মিয়ানমার রোম সংবিধিতে সই না করলেও বাংলাদেশ এতে সই করেছে।
মিয়ানমারে সংগঠিত গণহত্যার অভিযোগের পর তার শিকার ব্যক্তিরা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে সই করায় আইনে তাই রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার সম্ভব। রোহিঙ্গারা যদি মিয়ানমারের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যেত তবে বিচার সম্ভব ছিল না। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় বিচার সম্ভব।
তিনি বলেন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তকারী দল সুষ্ঠু পদ্ধতিতে আলামত সংগ্রহের কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে আদালতের কাছে কেউ সন্দেহভাজন নন।
তবে আলামত সংগ্রহের প্রক্রিয়া গোপনীয়। এটা পক্ষপাতহীনভাবে চলবে। অপরাধ প্রমাণের মতো সন্তোষজনক আলামত সংগ্রহ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিচার শুরু হবে না। ফলে পর্যাপ্ত আলামত সংগ্রহ করা পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলতে থাকবে। আলামত সংগ্রহের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজের সহায়তা নেয়া হবে।
আইসিসি’র প্রসিকিউটর দফতরের এই পরিচালক আরও বলেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার আলামত সংগ্রহে বাংলাদেশ খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
এজন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার কোনো সহায়তা করছে না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানানোর পরও মিয়ানমার এ ব্যাপারে কোনো সহায়তা করছে না।
তিনি বলেন, আইসিসি বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার ব্যাপার। এতে আইসিসি কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, আইসিসিতে বিচার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অনেক চ্যালেঞ্জ আছে সামনে। তবে একদিন না একদিন বিচার হবে। বিচার হলে ভবিষ্যতে কেউ গণহত্যা করার সাহস দেখাবে না।
আইসিসি পরিচালক পাকিসো মচোচোকো বলেন, গণহত্যার সঙ্গে জড়িত যেই হোক, যত শক্তিশালীই হোক তাকে বিচারের আওতায় আসতে হবে। তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিয়ানমার আলামত সংগ্রহে সহায়তা না করলেও তারা বিচার বন্ধ করবে না। আলামত সংগ্রহের নানা উপায় আছে। আইসিসি নিযুক্ত আলামত সংগ্রহকারী দলের লোকরা ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরে আছেন। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
তারা অভিজ্ঞ তদন্তকারী দল তাই নানাভাবে জটিল পদ্ধতি অবলম্বন করে আলামত সংগ্রহ করছেন। অনেক ফুটেজ, অনেক নিবন্ধ আছে। মিয়ানমার সহায়তা না করায় প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিচার হবেই।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইসিজে এবং আইসিসির বিচার প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলতে পারে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে অপরাধ প্রমাণ হলেও মৃত্যুদণ্ড হবে না। সর্বোচ্চ সাজা আমৃত্যু কারাদণ্ড। আলামত হিসাবে কফি আনান কমিশনের দলিলসহ অনেক কিছুই বিবেচনায় নেয়া হবে। তদন্ত নানাভাবে হচ্ছে। অপরাধ প্রমাণে কোনো কিছু করা থেকে বাদ পড়বে না।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৯ সালের নভেম্বরে আইসিসি পরিকিউটর ফাতু বেনসোদার অনুরোধে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা তদন্ত করার জন্য আইসিসির বিচারক অনুমতি দেন।
ফাতু বেনসোদা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুরতায় মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়ে থাকতে পারে। ইতিমধ্যে আইসিজে বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে কিছু অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়ার পর গণহত্যার বিচারের যুক্তি জোরালো হয়।