অর্থনীতি ডেস্ক: ব্যাংকিং কমিশন গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, একে স্বাগত জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তবে সংস্থাটি বলছে, শুধু কমিশন গঠন করলেই হবে না, কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
তা না হলে যে লক্ষ্য নিয়ে কমিশন গঠন করা হচ্ছে, তার সুফল পাওয়া যাবে না। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমরা নাগরিকরা এখন অসহায় আতঙ্ক নিয়ে ভয়ংকর ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি। সবচেয়ে বেশি বিচলিত হওয়ার বিষয় হচ্ছে, গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পুরো ব্যাংকিং খাত এখন জিম্মি হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে।
আট বছর আগে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর থেকেই আমরা বলে আসছি, একটি ব্যাংকিং কমিশন করার জন্য। শেষ পর্যন্ত সরকার তা গঠন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি এবং সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করছি।
তিনি বলেন, এটা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই সিদ্ধান্ত এসেছে জেনে আমরা খুবই খুশি। এটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি। তবে গঠিত কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে হবে। কাজ করার পরিবেশ ও সুযোগ দিতে হবে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর তিনি কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও কমিশন আর হয়নি। সরকার এবার এই কমিশন গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বুধবার বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই এই কমিশন গঠন করা হবে।
কমিশন গঠন নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদসহ কয়েকজনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই কমিশন যেন সমস্যা বের করার পাশাপাশি সমাধান বাস্তবায়নও করতে পারে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যা অনেক গভীরে। এ সমস্যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে দিয়েছে, ধারাবাহিক অগ্রগতিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। ব্যাংকের অনেক টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে যে আইন রয়েছে, একে কমিশনের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং টেকসই সমাধান ও বাস্তবায়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্টোলেন (চুরি যাওয়া) অ্যাসেট রিকভারি প্রোগ্রাম নামে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের একটা প্রকল্প আছে। অনেক দেশ এই প্রোগ্রামের অংশীদার হয়ে বাইরে থেকে টাকা ফেরত আনতে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারতের বিজয় মাল্লার যে ইস্যুটা আছে, এ বিষয়ে ইউকে কোর্ট একটা রায় দিয়েছে- ‘হয় তুমি ভারতে ফেরত যাবে আর নয়তো তোমাকে টাকা দিতে হবে।’ এ ধরনের উদ্যোগগুলো গঠিতব্য কমিশনে রাখতে হবে। যাতে দেশ থেকে চলে যাওয়া টাকা ফেরত আসে। এটা একটা উত্তম চর্চা, এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমছে না, যা বড় উদ্বেগের বিষয়। সুযোগ-সুবিধার পরও খেলাপি ঋণ না কমার অর্থ হচ্ছে- ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ বেশি, যারা জনগণের অর্থ ফেরত দিতে চায় না। এতে ভালো গ্রাহকদের জন্য বৈষম্যও তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই ব্যাংকিং কমিশন জরুরি।
সরকার এমন উদ্যোগ নেয়ায় সিপিডি খুশি। কারণ, আট বছর ধরে সিপিডির পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হচ্ছে। তবে যদি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হয়, সেক্ষেত্রে সিপিডির কিছু প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- এই কমিশন হতে হবে অস্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ তিন থেকে চার মাস মেয়াদি। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। ব্যাংক খাতের সমস্যার কারণ, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কীভাবে দায়ী, তা কমিশন স্পষ্ট করে জানাবে এবং সমাধানের সুপারিশ করবে।
তিনি বলেন, কমিশনকে বড় ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এককথায়- সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতামত নিতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতার জন্য কমিশন কী করছে, তা সময়ে সময়ে জনগণকে জানাতে হবে। এর সদস্য নির্বাচনও হতে হবে দক্ষতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও সততা বিচার করে, যাতে সদস্যরা নির্মোহভাবে প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, কমিশন গঠনের সময়ই কমিশনের সুপারিশ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, এর সুনির্দিষ্ট পথরেখা বা পরিকল্পনা থাকতে হবে। কারণ অনেক কমিশন হয়, কিন্তু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। এজন্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে সংকল্প ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বক্তব্য দেন।