অনলাইন ডেস্ক : আঙ্গুরা বেগম এখন আর তার মেয়ে শিরিনকে অকর্মা বলেন না। অথচ, ‘তুই অকর্মার ঢেঁকি, তোকে দিয়ে কিছু হবে না। অমুকের মেয়ের পা ধোয়া পানি খা গিয়ে’- মায়ের এসব কথা শুনতে শুনতেই ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় পার করেছেন সাতক্ষীর সদরের দহকোলা গ্রামের শিরিন আক্তার। যিনি ৭ বছর ধরে দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব ধরে আছেন। বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় শিরিনের মা এখন বলেন, ‘তুই তো আমার সোনার মেয়ে।’
শেখ আবদুল মজিদ ও আঙ্গুরা বেগম দম্পতির কোনো ছেলে নেই। চার বোনের মধ্যে শিরিন দ্বিতীয়। বিকেএসপির সাবেক এই শিক্ষার্থী এখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অ্যাথলেট। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান হলেও খেলার মাঠে দ্বিতীয় কমই হয়েছেন। প্রথম হওয়াটাই তার সবচেয়ে বড় নেশা।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দেশের দ্রুততম মানবী হওয়ার পর আর পেছনে তাকাননি শিরিন। এক এক করে মোট ১১ বার জিতেছেন মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের স্বর্ণ। সর্বশেষ জিতলেন শুক্রবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ৪৪তম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে।
বৃহস্পতিবার রাতে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন শিরিন। ‘বাবা ও মা দুইজনই বলেছিলেন- চিন্তা করিও না। তোমার সাথে আল্লাহ আছেন। আমি বাবা-মায়ের দোয়া ও আল্লাহর নাম নিয়ে দৌড় শুরু করেছিলাম। রাতে আবার কথা বলব’- টানা ১১ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বলছিলেন শিরিন আক্তার।
কবে থেকে আপনার মা অকর্মা থেকে সোনার মেয়ে বলা শুরু করেছেন? বিজয়ের হাসি তখনো লেগে আছে শিরিনের ঠোঁটে। প্রশ্নটা শুনে হাসি বেড়ে গেলো। বললেন, ‘আমি যখন দেশের দ্রুততম মানবী হওয়া শুরু করলাম তখন থেকেই বাড়ি গেলে মা বলেন আমার সোনার মেয়ে এসেছে। এখন বাবা ও মায়ের কাছে আমি সোনার মেয়েই’- বলছিলেন শিরিন আক্তার।
মায়ের চোখের সেই ‘অকর্মার ঢেঁকি’ শিরিন এখন দেশের অসংখ্য তরুণীর আইডল। অনেকের কাছ থেকে যখন শোনেন, ‘আমি শিরিন আপুর মতো হতে চাই’ তখন দেশসেরা এ নারী অ্যাথলেটের মনে পড়ে যায় তার মায়ের সেই কথা।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিরিনের অবস্থান কী? ওটা বাদ দিন। শিরিন তো দেশের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোরে দৌড়ান তাই না? অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে তাকে যে হারাতে পারছেন না কেউ। ছেলেদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে গত সাত বছরে মুখ বদল হলেও মেয়েদের ইভেন্টে শিরিন যে অপ্রতিরোধ্য।
শিরিন বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে সুপারস্টার। আর শিরিনের চোখে সুপারস্টার তার কৃষক বাবা শেখ আবদুল মজিদ। শিরিনদের পরিবার এক সময় অস্বচ্ছল থাকলেও, এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে দারুণভাবে। এর পেছনে অবদান রাখতে পেরেও অনেক তৃপ্ত সর্বশেষ ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে ১১.৮০ সেকেন্ডে দৌড়ে সেরা হওয়া মেয়েটি।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ২০০৭ সালে ভর্তি হয়েছিলেন শিরিন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়েছেন ২০১৪ সালে। এখন চাকরি করছেন বাংলাদেশ নৌবাহনীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী ইতিহাসে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করে ক্রীড়াবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মাঝে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ মাসের বিপিএড কোর্সও করেছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের দৌড় থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে জাতীয় লড়াই- শিরিন প্রথম হবেন এটা যেন নির্ধারিত। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ কি সামার অ্যাথলেটিকস- ১০০ মিটার স্প্রিন্ট শেষে শিরিনের পাশে কখনও মেজবাহ, কখনও হাসান, আবার কখনও ইসমাইল দাঁড়িয়েছেন। ‘নতুন রাজার পাশে পুরোনো রানী’ কিংবা ‘পুরোনো রানীর পাশে নতুন রাজা’- গণমাধ্যমে এমন শিরোনামই তো হয়ে আসছে গত ৭ বছর ধরে।
কেমন ছিলেন ‘বালিকা শিরিন?’ টানা ১১ বার ১০০ মিটারে সেরা হওয়া নারী অ্যাথলেট বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই উশৃঙ্খল টাইপের ছিলাম। অনেক সাইকেল চালাতাম। আমাদের তখন গরু ও ছাগল ছিল। ঘাস আনতে সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে চলে যেতাম। আসলে ঘাস আনা নয়, আমার উদ্দেশ্য ছিল সাইকেল চালানো। বাবা পছন্দ করতেন না। বাবা ঘুমালে মায়ের কাছে বলে যেতাম।’
যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়ে প্রথম হতেন, তখন কখনও ভেবেছিলেন দেশের দ্রুততম মানবী হবেন? শিরিন হেসে বললেন, ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ কী, সামার মিট কী আর দ্রুততম মানবী কী- কিছুই বুঝতাম না তখন। নিয়ম ছিল, যে প্রথম হবে তাকে ধরবেন প্রধান অতিথি। আমি প্রধান অতিথি বরাবর দাঁড়াতাম। সবার আগে গিয়ে তাকে ধরে ফেলতাম। প্রথম হয়ে পুরস্কার নেবো, স্কাউটদের মতো করে প্রধান অতিথিকে স্যালুট দেব- এসব আমার বেশি ভালো লাগত।’