দেশের খবর : প্রতিদিনই করোনায় প্রাণ হারাচ্ছেন শতাধিক মানুষ। এমন অবস্থায় পোশাক মালিকদের অনুরোধে বিধিনিষেধের মধ্যেই কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে আকস্মিক ১ আগস্ট থেকে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা খোলা থাকবে বলে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রজ্ঞাপনে শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার জন্য পরিবহন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক আয়োজন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিকদের টিকার আওতায় না এনে, ফের গাদাগাদি করে কাজ করাতে বাধ্য করছেন মালিকরা। তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত।
চাকরি হারানোর ভয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে আটকে থাকা লাখো শ্রমিককে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে একদিনের মধ্যে কর্মস্থলে ফেরত আসছেন পোশাক শিল্পের কর্মীরা।
রফতানিমুখী গার্মেন্ট খুলে দেয়ার ঘোষণায় শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় প্রবেশ করেছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভাড়া নৈরাজ্যসহ পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা।
ঢাকায় ফেরা শ্রমিকরা বলছেন, শুক্রবার রাতে কারখানার সুপারভাইজাররা ফোনে কর্মস্থলে আসতে বলেছেন। আগামী ১ আগস্টের মধ্যে কর্মস্থলে না আসতে পারলে অনেকেই চাকরি হারাবেন এই শঙ্কায় ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় কয়েক গুণ ভাড়া বেশি দিয়ে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরছেন।
দুপুরে আমিন বাজার ব্রিজে দেখা হয় মো. সোহাগ হোসেনের সঙ্গে। পাবনার কাশীনাথপুর থেকে আসা এই পোশাক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা অফিসে সময়মতো না গেলে চাকরি থাকবে না।’ নারায়ণগঞ্জের টিআইসি নামের একটা গার্মেন্টে লোডারের কাজ করেন তিনি। কাঁধে একটি ও দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে আমিন বাজার ব্রিজ পার হয়ে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলেন।
কাশীনাথপুর থেকে সিএনজিতে পাবনার কাজীর হাট আসেন। সেখান থেকে পিকআপে করে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। পরে প্রাইভেটকারে আমিন বাজার এসেছেন সোহাগ। পুরো যাত্রায় তার ১৩০০ টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানান এই শ্রমিক।
তিনি বলেন, ‘আমার ছুটি ছিল ৮ দিন, আগামী ৫ তারিখ পর্যন্ত। গতকাল রাতে হঠাৎ করে স্যার ফোন করে বলছে ১ তারিখে নাকি অফিস খোলা। এজন্য অনেক ঝুঁকি নিয়েই চলে আসতে হলো। কষ্ট যাইহোক যেহেতু আমরা গরিব মানুষ আমাদের চাকরিটা বাঁচাইতে হবে।’
আমরা অনেক কষ্ট করে আসছি। গার্মেন্ট খোলা রাখার পাশাপাশি গাড়িও খুলে দেয়া উচিত ছিল। অন্য শ্রমিকরাও বলছেন, গতকাল রাতে গার্মেন্ট থেকে সুপারভাইজার তাদের ফোনে ঢাকায় ফিরতে বলেছেন ও ১ তারিখ ফ্যাক্টরিতে দেখা করতে।
রবিউল ইসলাম নামের আরেক গার্মেন্টকর্মীও একই কথা জানান। তিনি বলেন, গতকাল রাত ৮টার পরে আমাকে ঢাকায় ফিরতে বলে আমাদের সুপারভাইজার। চাকরি বাঁচাতে ১৫০০ টাকা খরচ করে তিনি ঢাকা পর্যন্ত এসেছেন বলে জানান।
আমিন বাজারে কর্মরত দারুস সালাম ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট ফাহিদ আহমেদ বলেন, কলকারখানা শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরার প্রেসার তুলনামূলক বেশি। আগামীকাল থেকে ফ্যাক্টরি খুলে দিচ্ছে এজন্য সকাল থেকেই শ্রমিকরা ঢাকায় ফিরছেন। প্রমাণ দেখানো সাপেক্ষে আমরা ছেড়ে দিয়েছি। যারা বিনাপ্রয়োজনে বের হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তবে গার্মেন্টে ফিরতে কাউকে বাধ্য করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মালিকরা। ফতুল্লা এপিরিয়ালসের মালিক বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, শ্রমিকদের বাধ্য করব কিভাবে? আমরা যেটা করেছি ফোনে বা এসএমএসে সুপারভাইজারদের বলছি, আপনারা যার যার লাইনের শ্রমিকদের বলে দেন ফ্যাক্টরি চালু হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাক্টরি চালু হচ্ছে আর বাধ্য করা দুটো তো এক না। শ্রমিককে চাকরি থেকে বাদ দিতে তো আমরা পারব না। একটা তো আইন বলে আমরা তাকে বাদ দিতে পারব না। আমি ফ্যাক্টরি খুলছি তাকে তো বলতেই হবে তুমি কাজে যোগদান করো। তাকে তো ইনফর্ম করতে হবে। এখন এটা যখন সুপারভাইজাররা শ্রমিকদের বলছে, সেটা তার ল্যাঙ্গুয়েজে বলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ তারিখের আগে চাকরিতে না আসলেও কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে না। কারও কোনো চাকরি যাবে না, এটা বাংলাদেশের শ্রম আইন ও মালিকপক্ষ গ্যারান্টি দিচ্ছে।’
শ্রমিকদের কষ্ট লাঘবে গণপরিবহন খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বাস চালু থাকলে সমস্যা কোথায়। এই জিনিসটা আমি বুঝি না। পরিবহন খোলা রাখলে সবার জন্য ভালো। এই জিনিসটা চেকিংয়ের মধ্যে রাখতে হবে। কেননা আজকে তো গার্মেন্ট শ্রমিকদের ফিরতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু যারা টিকা, চিকিৎসা নিতে ঢাকা আসছে তাদের তো বেশি টাকা খরচ করে ঢাকায় আসতে হচ্ছে।’
তবে চিত্রনায়ক ও ব্যবসায়ী অনন্ত জলিল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়ে গতকাল রাতে একটি পোস্ট করেন।
সেখানে তিনি লেখেন, ‘এতদ্বারা এ.জে.আই গ্রুপ ও এ.বি গ্রুপে কর্মরত সকল কর্মকর্তা এবং শ্রমিক ভাই বোনদের উদ্দেশে জানানো যাচ্ছে, আগামী ১ আগস্ট থেকে আমাদের ফ্যাক্টরি সম্পূর্ণভাবে খোলা থাকবে। তাই সবাইকে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো, কেউ যেন অনুপস্থিত না থাকে।’
এরপরেই নেটিজেনদের তোপের মুখে পড়েন এই চিত্রনায়ক। অধিকাংশের ভাষ্য- গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গ্রাম থেকে কীভাবে আসবে শ্রমিকরা?
গার্মেন্ট শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল বলেন, কারখানা চালুর আগে শ্রমিকদের জন্য পরিবহন, টিকা ও ঝুঁকি ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা গত বছর দেখেছি শিল্প মালিকরা ঢাকায় অবস্থানরত শ্রমিকদের দিয়ে কারখানা চালু করার অনুমতি নিয়ে কিভাবে গ্রামে অবস্থানকারী শ্রমিকদের ফোন করে চাকরিচ্যুতের ভয় দেখিয়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। পূর্বের এই অভিজ্ঞতার পরেও সরকার ফের গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের স্বার্থ ও সুরক্ষা বিবেচনা না করার আরও একটি নজির।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের তীব্রতর যায়গায় রয়েছে। প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। ইতোমধ্যে হাসপাতাল রোগীতে পরিপূর্ণ রয়েছে। আইসিইউতে সিট খালি নেই।’
তিনি বলেন, ‘লকডাউন যদি সঠিকভাবে কার্যকর না করা যায়, তাহলে সংক্রমণের লাগাম টানা না যাবে না। সামনের দিনগুলো অনেক ভয়াবহ হবে।’
পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি বলেন, হাসপাতালের বেড আর কতটা বাড়ানো যাবে। রোগীর সংখ্যা বাড়তে না দেয়াটাই করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রধান কৌশল। সেজন্য লকডাউন বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।